কমলেশ মোবাইলটা দেখে।
তিনটে পাঁচ নাগাদ কৃষ্ণনগর ঢুকবে। ঘড়িতে দুটো পঁয়তাল্লিশ।
পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের ডাউনের দিকের গড়ানটায় খানিক ছায়া নামে দুপুরে। সেই
ছায়ার কিছুটা ভেতরে দাঁড়ায় কমলেশ। জ্যৈষ্ঠ মাসের খাঁ-খাঁ দুপুরে প্লাটফর্ম প্রায়
জনশূন্য। মাটি ফুঁড়ে হলকা উঠছে। দূরে সরু হয়ে যাওয়া রেললাইনের শেষ মাথা তিরতির করে
কাঁপছে গরম হাওয়ায়। কমলেশ সেই ছায়ার ভেতরে দাঁড়িয়ে, এতটা পথ আসার ক্লান্তিতে হাঁফ
ছাড়ে। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে লোকজনের ভিড় কাটিয়ে দাঁড়ায়।
চারপাশে অচেনা লোকের ভিড়। কোনও একটা দিক থেকে একটা ট্রেন এলেই মুখগুলো বদলে
যাবে। বদলাবে না শুধু কমলেশের মুখ। তার সাদা পাঞ্জাবি উজ্জ্বল
রোদে আরও সাদা দেখাবে কিছুক্ষণ, তারপর হেলে যাওয়া সূর্যের ছায়া লম্বা হতে হতে লঘু
ও শীতল হয়ে এলে ততটা শাদা আর থাকবে না তার পোশাক। তখনও কমলেশ নড়বে না। কারণ এই কৃষ্ণনগর সিটি, কিংবা পরের অথবা তারও
পরের কোনও একটা ডাউন ট্রেনের জন্য সে এখন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে ছায়াকাঠির মতো। ট্রেন আসলেই জিরাফের মতো গলা উঁচু করে খুঁজবে। খুঁজতে
খুঁজতে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডাউন ট্রেনে হঠাৎ সে দেখা পাবে লোকটার।
আজকে একটা অন্যরকম প্ল্যান করেছে কমলেশ। মোবাইলে
একটা ছবি তুলবে লোকটার। বেঁটে, কালো, সামনের দিকে খানিকটা টাক, সরু গোঁফের তেলতেলে
থমথমে একটা মুখ। কমলেশ তাকে প্রায় মাসখানেক একই জায়গায় একইরকম ভাবে
দেখার পরেও বুঝতেই পারছে না লোকটা আদৌ কথা বলতে পারে কিনা, কেননা সে আজ পর্যন্ত
একটা ঈষৎ ফাঁক করা ঠোঁটের চিলতে হাসি ছাড়া কিছুই দেখেনি।
নার্ভের রোগ আছে কিনা সেটাও আয়ত্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু
লোকটা এসে যখন নিরীক্ষণ করে কিছু একটা খোঁজার দূরাগত অভিপ্রায় নিয়ে কমলেশকে দেখে
এবং দেখতেই থাকে, তখন কমলেশ লক্ষ করেছে যে তার মাথাটা সামান্য কাঁপে। সম্ভবত
প্লাস পাওয়ারের চশমার পেছনে তার কোটরাগত চোখদুটো অস্বাভাবিক বিস্ফারিত দেখায় । সেই
দৃষ্টির অন্তনির্হিত অর্থ কী, সেটাও কমলেশ বুঝতে পারে না।
ব্যাপারটা তুচ্ছ এবং কমলেশের মতো মানুষের কাছে
গুরুত্বহীন হবারই কথা কারণ তার মতো প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মানুষ গত
প্রায় একমাস ধরে একইভাবে দুপুর থেকে সন্ধে অবধি একটা আনকা মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ
অবজার্ভ করার জন্য প্লাটফর্ম চত্বরে মূল্যবান সময় ব্যয় করছে এটা অবান্তর এবং
অবিশ্বাস্য। কমলেশও ব্যাপারটা সেভাবেই ভেবে উড়িয়েই দিয়েছিল প্রায়। একসময়
এলাকার প্রোমোটারদের সঙ্গে অবৈধ নির্মাণ কৌশলকে ধামাচাপা দেবার জন্য বখরার
টাকাপয়সা নিয়ে কিছু গোপন আলোচনার নিভৃত অথচ উন্মুক্ত এবং সন্দেহাতীত স্থান হিসাবে
প্লাটফর্মটাই বেছে নিয়েছিল কমলেশ আর কয়েকজন প্রোমোটার। সেই
সময়েই লোকটার আবির্ভাব। তার অস্বাভাবিক আচরণ কমলেশের চোখে প্রথমে তাচ্ছিল্য
এবং পরে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। তারপর থেকেই সে নিত্য আসে। অকুস্থলের
বাইরেও বারদুয়েক দেখার পর ঠিক সুবিধের মনে হয়নি লোকটাকে।
একটু ভয়ও পাচ্ছে কমলেশ। লোকটা কি তার নাড়ি-নক্ষত্র
সব জানতে পেরেছে? ওপর থেকে দেখলে সে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই স্ত্রী-পুত্র নিয়ে
সংসারী। স্বাভাবিক মধ্যবিত্তের গণ্ডি, চাকরিসূত্রে কিছু টাকা,
নিজস্ব একটা বাড়ি, একটা দু’চাকার বাইক। এইটুকুই। এর বাইরে তাকে আবিষ্কার করার কোনও
সুযোগ কমলেশ কাউকে দেয় না। তার আচরণে উচ্চবিত্তের ছাপ নেই। কালোটাকা, বেনামি
সম্পত্তি, অথবা তার অতীত জীবন কিংবা এই সময়ের যা কিছু অসামাজিক যা তার মতো কিছু
মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীরা নিজেদের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখে, সেগুলো তো কারওর জানার কথা
নয়! এত ভেতরের সিক্রেট কে জানে? তাহলে কমলেশকে মাপছে কেন লোকটা? কমলেশ একবার চোখ
বুজিয়ে মাথা ঝাঁকায়, না না এ অসম্ভব, হতেই পারে না।
ভাবনা ছাড়ে না কমলেশকে।
পেছন থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছে? কিছুই অসম্ভব না। বকলমে পৌরসভা চালায় কমলেশ। পৌরপিতা
তার কেনা গোলাম। সেটা অনেকের কাছেই ঈর্ষার। বেশ
কয়েকজনকে কমলেশ জানে যারা সুযোগ খোঁজে কমলেশকে টেনে নামানোর। লোকটার
ভাজা মাছ উলটে খেতে না জানা গোছের ভান তাহলে কি একটা ট্রেইন্ড অ্যাটিটিউড! সব শেখানো?
কমলেশের এক-একবার মনে হয় লোকটা গোবেচারা। মুখের সামনে মুখ রেখে কেমন একটা ক্যাবলা-ক্যাবলা
ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এত কাছে যে নিশ্বাস পর্যন্ত বোতামখোলা পোশাকের ভেতর
অনুভব হয়। গা ঘিনঘিন করে ঘামের গন্ধে। বড়-বড় চোখ দিয়ে কাঁপা মুণ্ডুটা
অস্থির করে তাকায়। কমলেশ বুক চিতিয়ে মুখ ঘোরায়। লোকটা তবু ঘুরেঘুরে তাকায়। বিরক্ত
লাগে। একদিন বলেই ফেলেছিল, কী হল? অত দেখার কী আছে? কে কার কথা শোনে। আবার মিটমিট
করে হাসে।
হতেও পারে তার কোনও পুরনো বন্ধু, মনে পড়ছে না। ছাত্রাবস্থায়
চেনা ছিল, এখন মনে নেই। কমলেশকে সবাই চেনে, কিন্তু তার পক্ষে সবাইকে চিনে রাখা
সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক, দারিদ্র্য এমন জিনিস যা মানুষের রূপ-গুণ,
স্বভাব-চরিত্র মায় খোলনলচে সব বদলে দিতে পারে। লোকটা হয়তো তাই। দিন আনে দিন খায়। খোলসটাই
পালটে গেছে, কী করে চিনবে কমলেশ! তবে এরা ধান্দাবাজ হয়, আমল দিলেই মাথায় চড়ে বসে। কমলেশ
এদের একদম পাত্তা দেয় না। সাবধানে থাকতে হয় তাকে, পা ফেলতে হয় গুনেগুনে। এমন ভাব
দেখাবে যেন কত আপনার! আসলে সব ওই ছোটবেলায় পড়া চাণক্যর শ্লোকের মতো। কী যেন বলে,
কমলেশ ভাবে, বিষের কলশি আর মুখে লাগানো মধু... সেই শ্লোকটা।
তবে আজ কমলেশ প্ল্যান করেই মাঠে নেমেছে। প্রথমে ছবি,
তারপর চলে যাবার ভান করে ফলো করা। ফলো করতে গিয়ে যদি বাগে পায় তাহলে একটা এসপার-ওসপার
আজই হবে। কোনও পরিস্থিতিতেই তার ভয়ের কিছু নেই। এই
শহরের যে কোনও জায়গায় সে দাঁড়িয়ে একবার হাঁক দিলে পঞ্চাশটা লোক হুমড়ি খেয়ে পড়বে। লোক
লাগিয়েই কেসটা সলভ করা যায়। কিন্তু এটা একটু অন্যরকম। সত্যি
যদি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যায়! লোকটা ধড়িবাজ।
কাউকে খুলে না বললেও এটা সত্যি যে ভয় সে পাচ্ছে। কেসটা
নিজে হ্যান্ডেল করা ভাল।
লোকটা নামে। ট্রেন ঢোকার সঙ্গে একটা দমকা হাওয়া ওঠে। গুমোট গরমে হাওয়াটা গায়ে লাগতে মনে হল ঝড় উঠবে।
কমলেশ মনে মনে বলল, আ! এখনই ঝড়ের সময়। লোকটা ঢাল বেয়ে নামছে। শোঁ
শোঁ শব্দ করছে হাওয়া, সন্ধের আকাশ দেখে বোঝা যায় না মতলবটা। তবে
হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা বলেই বিরক্ত লাগছে কমলেশের। লোকটা
কমলেশের সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়াবার আগেই কমলেশ আগ বাড়িয়ে তার সামনে টান হয়ে দাঁড়ায়।
লোকটা থমকায়। একবার মুখের দিকে তাকিয়েই ঘুরে গিয়ে লাইন টপকানোর জন্য
পা বাড়ায়। কমলেশ ভড়কে যায়। এরকম তো হয় না। লোকটা কি এটাও জেনে গেছে যে সে ওর ছবি
নেবে, ফলো করবে! জাদুকর নাকি! চোখের দিকে তাকিয়েই সব বুঝে চকিতে ধাঁ হয়ে গেল!
কমলেশ আলো-আঁধারে তাকিয়ে দেখল লোকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে লাইন টপকে ওপারে চলে
যাচ্ছে। এদিকে ঝড় উঠল বলে, বৃষ্টি হলেও হতে পারে। এরপর
লোডশেডিং-এ লোকটা গায়েব হয়ে গেলে দিনটাই বরবাদ। কমলেশ
তাড়াতাড়ি লোকটার পিছু নেয়।
টিপটিপ করে বৃষ্টি নামল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কমলেশ
দূরত্ব বজায় রেখে পা চালায়। এমন ম্যাদামারা লোকও যে এরকম হাঁটতে পারে জানা ছিল না,
এই ঠান্ডা ওয়েদারেও কমলেশ হাঁপিয়ে উঠছে। তা প্রায় মিনিট তিনেক হল। ছাতাও
নেই কাছে, ভিজে সপসপ করছে পাঞ্জাবিটা। লোকটা দিব্যি ছাতা উঁচিয়ে চলেছে। কমলেশ যেন
ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে। একটা পানবিড়ির দোকান পড়ল বাঁ-হাতি, তার গা দিয়ে
গলি। লোকটা যেই গলিতে ঢুকেছে কী ঢোকনি, ঝুপ করে আলো চলে গেল! কমলেশ হতভম্ব, কী হবে
এবার! লম্বা সরু গলি চোখে ঠাহর হতে হতেই
মালটা চম্পট দেবে নির্ঘাত। কমলশ ধৈর্য হারিয়ে গলিতে ঢুকেই হাঁক দেয়, এই যে
দাদা, একটু দাঁড়ান তো কথা আছে। কমলেশের আচমকা গলা পেয়ে কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে
ডাকল। চেনা লাগে গলিটা। কমলেশ ভয় পাবার লোক নয়। ঝুঁঝকো আঁধারে লোকটা
দাঁড়িয়ে, ছায়া ছায়া দেখা যাচ্ছে। কমলেশ এগিয়ে যায়, আপনি এখানে থাকেন?
না তো, লোকটা অন্ধকারে জবাব দেয়, চন্দননগরে থাকি।
এখানে কী করতে আসেন রোজ, কমলেশের কথায় ধমক।
লোকটা কথায় কান দেয় না, মিটমিট করে হাসে হয়তো, দেখা
যায় না। সে বলে, আমাকে আপনি চিনবেন না। আপনি কানা বাপিকে চেনেন? কানা বাপি?
যাকে লাস্ট বিধানসভা ভোটের আগে রুলিং পার্টির লোকেরা তারাপীঠ চলে যেতে বলল? মনে
পড়ছে? আর তারাপীঠে গিয়ে বাপি মারা গেল। মনে পড়েছে?
কমলেশের চোখদুটো অন্ধকারে স্থির হয়ে থাকে। এটা তো
অন্য লোক! এত টানটান গলায় কথা বলার লোক তো সে নয়। কমলেশ যেন কূলকিনারা পায় না
মানুষটার। লোকটা অন্ধকারের ভেতর থেকে আবার কথা বলে ওঠে, মারা
যায়নি, খুন হয়েছে। আর আমি মাঝখান থেকে জড়িয়ে গেলাম। শেষ
কথাগুলো লোকটা বিড়বিড় করে বললেও কমলেশের কানে পৌঁছায়।
কমলেশ কানা বাপির কথা ভাবছে। গলির শেষ মাথায় বাড়ি। বড্ড উড়ছিল বাপি। পার্টির
ভেতরের খবর জেনে গিয়েছিল। কিন্তু এই লোকটা বুমেরাং হতে চাইছে সব জেনেও! ছকটা এলোমলো
লাগছে!
কানাগলির হাওয়া কমলেশকে যেন ঝাপটা দিচ্ছে। আপনি
জড়িয়ে গেছেন মানে? কমলেশ অবাক হয়। লোকটা এবারও বিড়বিড় করে, আমি বাপির মাসতুতো দাদা।
মেসোমশাই, বাপি চলে যাবার পর থেকে একা। ক্যানসারের পেশেন্ট। আমাকে
রোজই আসতে হয়, মাঝেমাঝে রাতে থাকতে হয়। অবস্থা ভাল নয়। কমলেশ কী বলবে বুঝতে পারে না। সমবেদনার
কথা সাজাতে সাজাতেই লোকটা তার দিকে এগিয়ে আসে। সেই ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি! কমলেশ টের পাচ্ছে
তার নিশ্বাস। ফিসফিস করে লোকটা বলছে, বাপির বাবার কাছ থেকেই সব শোনা, বাপি রুলিং
পার্টিতে না থাকলেও ওকে সবাই খুব ভালবাসত, ওর ভালর জন্যই নাকি ওকে ওরা তারাপীঠে
পাঠিয়েছিল। মেসোমশায়ের তো তেমন ইনকাম ছিল না, পার্টির লোকেরা ওকে
নিজেদের দলে বহুবার চলে আসতে বলত, আমি আর কী বলব বলুন। আমার কথা শুনত না। তারাপীঠের
পয়সাটাও পার্টি দিয়েছিল।
কমলেশ ঝড়ের বেগ সামলায়। বৃষ্টি
নামছে জোরে। বিদ্যুতের চমকানিতে গলিতে একঝলক আলোয় কমলেশের ঠাহর হয়
লোকটা ঠায় তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঘন নিশ্বাস ফেলে সে বলে, তারাপীঠ যাবার আগের দিন
এলাকার এক বড় নেতা বাপির কাছে এসেছিল, মেসোমশায়ের বর্ণনা অনুযায়ী লোকটা ঠিক আপনার
মতোই। সেইজন্যই তো আপনাকে দেখতাম। হেঁ-হেঁ আমরা হলাম গিয়ে
ঢোঁড়ার জাত, কবে মরে গেছি। আমাদের আবার বাঁচা কী! আপনি ও নিয়ে একদম ভাববেন না। আসুন, ভেতরে একটু বসি, বৃষ্টি কমলে যাবেন। ভয়
নেই, মেসোমশাই এখন কাউকে চিনতেও পারেন না।
কমলেশের মনে হল গলিটা অনন্ত সর্পিল, তাকে
আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরছে, লোকটা হাসছে, আসুন-আসুন।
চিত্র- অনুপম মুখোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment