বাক্‌ ১৪০ ।। সর্বাংশে কথা বলো ।। শতানীক রায়





তোরঙ্গের ভেতর থেকে কথা বলছি
শোনোআজকে আমার কথাসরিৎসাগর হচ্ছে
ক্রমাগত মুখ কাঁপছে
কল্পনা করছি দুরূহ একা একটি বাড়ি
আছি শুধু চুপ করে আছি
বিরহপদ্ম যাপন করতে করতে আছি
শৃঙ্খলে এখন আর কী ঢাকতে পারি!
কব্জা থেকে ভোর
শরীরের আজান থেকে জ্যোৎস্না
কাঠচাঁপা ফুল কথা বলো
বালিশ বিছানা তোমরাও কথা বলো
অজস্র বলো
অসংখ্য করো
এই ব্রহ্মাণ্ড অজস্র করো
এই শরীরে আর কি কোনো কিছু নেই
কোনো শরীর নেই
কথা নেই
বিদ্যানিধি নেই
রিপু কারণশরীর কিছু নেই
কথাসরিৎসাগর হচ্ছে
দেখোকর্নেল দেখো
তোমার করুণ মোরগটি ডাকছে
ঘন্টা ধ্বনি হয়ে আলাদা হচ্ছে
কোথাও একজন কান্না আর বিভাজন হচ্ছে
শহর নদী নালা প্রাচীন গ্রীস
এক হচ্ছে
দেখোকর্নেল আজান হও
শব্দে বাক্যে গানে মরুগানে
বিভাজন হোক
হাজার বছর আমি একাকী আছি
কোনো বালির মানুষ 
কোনো লোচন সুন্দর নেই
হিংসা প্রীতি লতাফুল নেই
করুণ যীশু মর্মান্তিক শুয়ে আছেন
কীভাবে কবর করব বলো?
এই হত্যা এই কামিনী আজ দূর হোক
কল্পনা করো হে কর্নেল
কল্পনা করো

একটি গাছের সঙ্গমে বেঁচে আছি
ভাবছি যাতে কেউ না দেখে
এভাবে আমাকে খচিত হয়ে
রূপরঙ্গম অথবা কেমন সব কথা নিয়ে
মধু নিয়ে কালক্ষয় 
ক্রমের পর ক্রম পেরোনো
যে-সব অক্ষমালা 
জপে জপে ভ্রম উৎপাদনের ক্রিয়া
লোমশ থেকে লোমহীন হওয়ার ব্যথা
সাপ উজাগর হওয়া গানে
কুহুরব উজানে কেমন এক ভোর
দেখে রাখো কর্নেল, 
আমাদের এই নিত্য নিসর্গ মাখানো জীবনে
কুহুরবের মানে বদলে যায়
মানে তৈরি হয়
আবার রক্ত মুছে গিয়ে
আশংকা মুছে গিয়ে
হাঁ করা গাছের কাণ্ড মুছে গিয়ে
হাত পেতে থাকা 
সাইকেলের চাকার কাছে
প্রার্থিত হওয়া
ব্যক্ত হওয়া 
শব্দ করে ওঠা হরিণের কাছে
আবারকর্নেল এত এত ব্রহ্মলোক 
আনবিক সবকিছু 
চলাচল ধরনী 
প্রতিফলন 
বেদ
অর্থ তাড়না 
শব্দতরণী 
মাঠ পেরোনো
সরবত
শরীরের চুল খোলা সর্বস্ব
সব দিয়ে এ কেমন কায়া
হরিণের মুখ হারিয়ে
নাগিনীর ফণা লেখা হওয়া
কাণ্ডারী হওয়া 
ধিক ধিক করে জ্বলা আলো
এই আলোর কাছে
বারবার মরে যাওয়া
মরে যাওয়া প্রতিবার

এই ধরো ভোর রাতে উঠে আকাশটাকে দেখছি
মোহ নির্মোহ বিষাদ কিছু নেই
জন্মে কিছুটি নেই 
মৃত্যুও অযুত কারণবিশেষ এরকম শব্দ ধ্বনিগুলো 
বিরোধ করে আসে
পাতার মধ্যে বিরল যেভাবে ঘটে
পর্বতের মতো উঁচু
কর্নেল, তোমাকে আরও বড়ো হতে হবে
বেড়ালের পাঁজর
হাঙরের দাঁতের মতো
এই সবকিছু 
সহায় হও একবার কর্নেল
আমার যে কিছুই করার নেই
পূর্বজীবনের ধান কত রইল
মাপছি কত কত মাছের আঁশ
মাংসের হাড় পড়ে থাকল
পরপর কাপড়ের টুকরো
গমের খোসা ফসলের ডাটা 
পালকগুলোও থাকল 
কত কত মোরগের চোখ
খুবলে খাওয়া নরকরোটি
ধূপগন্ধ স্নানঘরও 
চিৎকার তবুও থামেনি
এই শরীরের ৩২ কোটি কোণ থেকে
কেউ যেন ভুলে যাওয়ার গান গাইছে
সন্ন্যাসী তার আপন অয়ন রেখে হাসছে
অক্ষর অক্ষর বাড়ছে
পৃথিবীতে এখন এত এত অক্ষর
মানুষে-মানুষে অদলবদল হচ্ছে
অক্ষর বেদনা ভাষা তিতিক্ষা 
রেণু আর হংসচর্ম 
সবকিছু একত্রে এনে 
কর্নেল দেখোহিসেব ঠিক আছে তো?
আজকের রাতে তারা গুনে রেখো
কর্নেল তোমার কাছে কত টাকা থাকল একটু বলবে?

দীর্ঘাচ মলিনাম্বরা...

তন্ত্র তন্ত্র বলে চিৎকার করলেও 
এইসব শরীরে ঘুম গাঢ় আরও ঘন হয়
নিদারুণ স্বপ্ন দেখলে মনে হয় 
গান গাইছি পাহাড়ের ধারে বসে
গান গাইছি 
গাছের পরিত্যক্ত গুড়ি নিয়ে খেলা
হাড়ের বাজনাগুলো
ওলটপালট সবগুলো এরকমই হয়
ক্রমাগত সোনার গন্ধ 
পুরোনো বাসনের গন্ধ 
না-দেখা মাংসের অভাব 
এই সবকিছু বোধ করছি
কীভাবে সরস গান গাইছে পাখি
কেমন করে উট বছরের পর বছর
বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষকে
বন্যার শব্দে ঘুম গাঢ় হচ্ছে আরও
কর্নেল আমাকে সোনার কাঠি ছোঁয়াও 
ঘুম এখানে রঙিন কোনো পৃষ্ঠা খসানো রাত
মহিমান্বিত হওয়ার রাত
আমাদের আরোগ্য আর ব্যথা হয়ে ওঠার রাত
কীভাবে তুমি মাংস নিয়ে খেলবে জানো?
কর্নেল, আজ আমাকে একবার হাসাও
নয়তো তীব্র কাঁদাও
অতি কালো এক প্রজাপতি নিয়ে কারবার
আমাদের শরীর বলে কিচ্ছু থাকছে না
শৈশবের গীতবিতান লিখেছিলেন 
এমনই বললেন অমিতাভদা
লম্বা এবড়োখেবড়ো থ্যাবড়ানো
মুখগুলো গিলে খেয়েছে বাড়িগুলোকে
সময় বলে কিছু থাকছে না
মেয়ে ছেলে বৃদ্ধ বৃদ্ধা সব 
এলানো সূর্যের গায়ে চক্কোর কাটছে
আমি সেইসব আধবোজা মুখগুলো দেখতে চাই
অতি আলোর কাছে যেতে চাই 
যেখানে যেতে যেতে 
আমি শূন্যে রূপান্তরিত হব
জীর্ণ কাপড় পোড়ার মতো অদ্ভুত
অদ্ভুত চেতন অচেতন সবকিছু 
দানব দৈত্য হেঁটে আসার মতো 
সময়টা কাঁপছে 
মুখ বদলে বদলে 
কখনও শিশু কখনও পশুরও অধিক
এভাবে কতদিন পারবে কর্নেল


                                        চিত্র- অনুপম মুখোপাধ্যায়

7 comments:

  1. অসাধারণ হচ্ছে এই লেখাগুলো...প্রীতমবসাক

    ReplyDelete
  2. বাহ বাহ। খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  3. প্রথম লেখাটি কিছুদূর এগোনোর পরে বারে বারে যে "কর্ণেল"-এর প্রতি সম্ভাষণে কারণে-অকারণে ককিয়ে উঠছেন লেখক তিনি রক্তমাংসের নাকি ফিকশাস, মার্কেজের কালজয়ী উপন্যাসের চরিত্র সেই সূত্রে অনুষঙ্গ বহন করে আনছেন তা নিয়ে অহেতুক কৌতুহলী না হয়ে বলি, ওই আর্তি ক্রমশঃ এক অন্ধবিশ্বাসী ভক্তের ভক্তির মত লেখার আগাপাশতলা ছড়িয়ে লাট হয়ে গিয়েছে। তার চাইতে বড় কথা, ব্রহ্মান্ড-গ্রহনক্ষত্র-র সঙ্গে ইউরোপীয় দর্শন নিয়ে লেখকের সাম্প্রতিক অবসেশন লেখার বারোটা তো বাজিয়েছে অনেকদিন হল, ইদানীং কবিতার ধ্রুপদী একঘেয়েমীগুলি, যথা স্টেটমেন্টের মধ্যেও উত্তম পুরুষ মধ্যম পুরু সর্বনামে টানা উপদেশ বর্ষণ, গায়ের জোরে পাঠককে নিজের তোলা ফটোগ্রাফ দেখতে বাধ্য করবার কষ্টকল্পিত প্রয়াস সর্বোপরী অন্তর্নিহিত দর্শনের স্বার্থে সম্পুর্ন নিজের বাস্তববিবর্জিত অনুষঙ্গ ও অবজেক্টের বান ডাকিয়ে (উট, মহাবিশ্ব, ব্রহ্মান্ড, নাগিনী, হরিণ, হাড়ের বাজনা, গমের খোসা, হংসচর্ম, হাঙরের দাঁত, বেড়ালের পাঁজর ইত্যাদি প্রভৃতি ) পাঠককে সমীহ ও সম্বিতহারা অবস্থার মাঝামাঝি দ'-এ ফেলে অনেকটা পড়ে ফেলবার টোলট্যাক্স আদায় করবার মত স্বাভাবিক প্রবণতাগুলি ইদানীং স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লেখকের কলমে। এর কারণ হিসেবে অজস্র অসংখ্য লেখার অহরহ উদগার এবং তা কাগজ বা কিবোর্ডে পড়তে না পড়তেই তথাকথিত সম্পাদকদের লুফে নেবার ক্রেজটাকে দায়ী করাই যেত, যদি না লেখকের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হতাম। সেসূত্রে জানি, তার যাপন ও আপনপাঠ-এর মধ্যে মস্ত মস্ত বই ও অন্যান্য পপুলার মিডিয়া স্থান করে নিয়েছে, যারা নিজেকে বাদ দিয়ে সবকিছু চেনায়। স্বভাবতই, যে আবর্তে পড়ে ঘুরপাক খেতে খেতে লেখকের মৌলিকতা আলোবাতাস না পেয়ে দর্শন ও সাহিত্যের বর্ণিল ইতিহাসের তলায় চাপা পড়ে ফ্যাকাশে হয়ে পড়ছে, সেইখান থেকে বেরোতে সূর্যের আলো ব্যাতিত আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না। ওঁকে একটি প্রচলিত বাগধারা স্মরণ করিয়ে রাখি। যে নদী হারায়(নাকি "হারায়ে" হবে? সেক্ষেত্রে তো স্রোতের পরে কমা বসবে না!) স্রোত, চলিতে না পারে/সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে। এটুকুই।

    ReplyDelete
  4. ভীষণ সুন্দর লেখা । সবকটা কবিতাই । কবিতাগুলোর ডিকশানও খুব সুন্দর, লেখার মধ্যে অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে যা পাঠককে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে ।

    ReplyDelete
  5. পড়তে পড়তে বারবার অমিতাভ মৈত্র কে মনে পড়ছিল

    ReplyDelete
  6. গৌরাঙ্গ16 March 2020 at 21:15

    ভুলভাল লিখলেইতো কবিতা হয়না।।

    ReplyDelete
  7. কবিতাগুলো উড়তে পারলো না যেহেতু আকাশেই ছিল।


    ReplyDelete