বাক্‌ ১৪০ ।। পিয়ানো আর চার্চের ঘন্টা ।। শতানীক রায়



বহুদিন পর আজ ভোরে চার্চের ঘন্টার ধ্বনি আলাদা হয়ে গিয়ে মিশল পিয়ানোর সঙ্গে। এটা হওয়ার কোনো তাগিদই প্রকৃতির ছিল না তবুও হলযেমন ঋজু ফলমূল গাছের সঙ্গে সংযুক্ত থেকেও কোথাও মনে হতে থাকে তা যেন আমার খাদ্যের জন্যই উপযুক্ত হয়ে এসেছে। মনোগ্রাহীতা আর সঙ্গে সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া ও থাকার মধ্যেও একটা অবাক করা বোধ কাজ করে যে যখন সর্বংসহা হয়ে একাত্ম হতে গিয়েও গাছকে ডাকে বিচ্ছিন্ন হও। ঘন্টাধ্বনি আলাদা হয় সবসময়ই ঘন্টা থেকে। ক্রোধ যেন। রক্তিম হয়ে ওঠা বাজনাসহ ঘন্টাটা এত ভোরে কেমন বিচিত্র একটা অন্তর্লীন ব্যাপার ঘটাতে থাকে। শরীরে যেমনটা ঘটে শিরা-উপশিরায় আমি মানুষ হয়ে উঠি। আমাকে অনেক ধীর হতে হয় একটি মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করতে যাওয়ার আগে। ওখানে কেউ কেঁদে উঠলে কীভাবে জল ছলকে ওঠার নিয়মে আবার করুণ মধ্যরাতের পিয়ানো উঠে আসে। তখন বড়ো বেশি পিয়ানোটা সময় থেকে বিচ্ছিন্ন একটা কোনো বোধ যে বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার বোধগুলোকে একে একে ত্যাগ করতে থাকে। ত্যাগের ভেতর দিয়ে সোনা হয়। মানুষের শরীরে কেমন সমস্ত অদ্ভুত যোগাযোগ আমাকে আরো শান্ত করে। মুগ্ধ করে। মায়া গড়িয়ে রাখে। মায়াও তবুও বিচ্ছিন্ন আলাদাভাবে বিচারক এই সবকিছুর। চারপাশে যতকিছু ঘটে চলেছে। এই যে মেঘ বৃষ্টি আনতে গিয়েও আনল না। এই যে পরিচ্ছেদহীন লিখে চলেছি আমি। জানি, কখনও অর্থ ফেরাতে পারব না আমি শুরু করতে পারব না এর কোনো শেষও নেই। মার্কেজের বড়ো গল্প কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না এভাবে অলীক হয়ে ওঠে। রঙের আধিক্য বেড়ে গেলে যেমন দৃশ্য আলাদা হয় দৃষ্টি থেকে। পরমাণু আলাদা হতে থাকে আমার সর্বংসহা গদ্য থেকে। আলপথ আলাদা হয়ে ওঠে জমি থেকে কেবল হাঁটছি বলেই আলপথ এতটুকু আলাদা তার অস্তিত্ব থেকে এমনও নয়। এমনও নয় যে, আমিই এই পথটাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করছি কিংবা আমার হাঁটাকে চিহ্নিত করছি আমারই একটা আস্ত লম্বা দীর্ঘপ্রসারী হাঁটা থেকে। পথও আলাদা গিয়ে যখন সর্বস্ব খোয়াতে থাকল কেন সে যুক্ত হয়ে থাকল আলাদা করা হল না এরও রঙিন সম্ভব আছে সদ্ভাব থেকে গেল এরকম কোনো কথা কোনো মর্যাদাফল থেকে। আবার আমার হাঁটাটাই দীর্ঘ হতে থাকল আরো আমারই সূচনা থেকে। আমি যে জন্মালাম আর চলতে শিখলাম। আবার শেখা থেকে আরো বেশি শিখলাম। শেখা এই বোধ আমাকে যতটা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ততটাই চলা আমাকে আরো বেশি শেখার কাছে নিয়ে গেল। করবীফুলের একটি বীজ থেকে যেমন আরো একটি করবীগাছ হবে আবার তারই ফুল দিয়ে আরো আরো করবী হবে। করবীর যেন শেষ নেই যেমন আমার এই রাতদিনের হওয়াগুলোর কোনো শেষ নাই। আমার শেখাগুলোর যেমন কোনো শেষ নাই। শিখছি না আদৌ নাকি শিখছি যা কিছু তা শুধু বোধ করছি এমন আমি শিখছি বলে। সচেতন হচ্ছি বলে আমি আরো সচেতন হচ্ছি এমনও নয় হয়তো-বা। শিখেছি বলেই হয়তো আরো শিখতে পারছি। পিয়ানোর আওয়াজের মতো যেটা ক্রমাগত আমার ধ্বনির বোধকে আলাদা করে শেখায় আবার ধ্বনিগুলোকেও পিয়ানো থেকে কোনো এক মহাবিশ্বের শূন্যে নিয়ে গিয়ে আমার বোধগুলোকে আলাদা করতে যায়। আমি আলাদা তবে আমার সমস্ত বোধ থেকে। আমার আদৌ কোনো এর মূল নাই বিনষ্টি নাই ছেদ নাই। শুধুই আলাদা হতে গিয়ে সংযোগের বোধ। সংযুক্ত হতে গিয়েও আলাদা হওয়ার বোধ। যেমন একই নামের চিহ্নিত দুটো মানুষ একই জীবনে আলাদা হয়ে পড়ে ছড়িয়ে যায় হয়ত। হয়ত আমাকেই আলাদা হতে হয় তাদের নামের অস্তিত্বের কাছে নাকি তাদের মাংসের বর্গমূলের কাছে। বড়ো বেশি এখানে আমাকে আশ্রয়দাতার মতো মনে হতে থাকেআশ্রয়দাতা তবে কে আমি না ঐ দুটো ভিন্ন মানুষ একই নামের অস্তিত্ব বহনকারী। এভাবে সর্বস্ব নিয়ে নেয় পিয়ানোটা আমার থেকে। আমার যা আছে পিয়ানোর ধ্বনিগুলো আরো বেশি করে আলাদা করে আমাকে খণ্ড অখণ্ড দুইভাবে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। সর্বশেষ আলাদা হতে থাকে সবকিছু সব বস্তু থেকে। কোনো কিছু আলাদা নেই তবুও আজ এই ঘন্টা আলাদা হল তার ধ্বনি থেকে। আজ পিয়ানো আলাদা হল আমার শোনার বোধ থেকে। আমার বোধ আলাদা হল দুটো ধ্বনি থেকে।


                                                            চিত্রঋণ- সালভাদর দালি

10 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো।
    "আমার যা আছে পিয়ানোর ধ্বনিগুলো আরো বেশি করে আলাদা করে আমাকে খণ্ড অখণ্ড দুইভাবে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।"- ভাবালো অনেকক্ষণ

    ReplyDelete
  2. "একই নামের চিহ্নিত দুটো মানুষ একই জীবনে আলাদা হয়ে পড়ে ছড়িয়ে যায় হয়ত। হয়ত আমাকেই আলাদা হতে হয় তাদের নামের অস্তিত্বের কাছে নাকি তাদের মাংসের বর্গমূলের কাছে। বড়ো বেশি এখানে আমাকে আশ্রয়দাতার মতো মনে হতে থাকে— আশ্রয়দাতা তবে কে আমি না ঐ দুটো ভিন্ন মানুষ একই নামের অস্তিত্ব বহনকারী।"
    ভীষণ ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  3. এইধরনের গদ্যে, যেখানে একটা ভাবনাস্রোত থাকে —
    শতানীক বেশ সফল। সম্প্রতি ওঁর গদ্যগ্রন্থটি পড়েও এমন মনে হয়েছে।
    বিস্তর পড়াশোনার সঙ্গে এর জন্য চাই চিন্তা করার ক্ষমতা ও নিজস্ব লিখনভঙ্গিমা।
    শতানীক আমাদের অনেক আগেই তা অর্জন করেছে।

    ReplyDelete
  4. গভীর ভাবে জলকে আন্দোলিত করতে পারবে । অনেক শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
  5. এই তো গভীর চিন্তা। চেতনার মধ্যে ঘুরপাক খায় বোধ। আগে পড়িনি। ভাল লাগলো শতানীক

    ReplyDelete
  6. গোটা গদ্য জুড়েই এক দুটো ফিক্সড কেন্দ্র আছে , যেমন থাকে এ প্রজাতির গদ্যে । শতানিক ঈর্ষণীয় ভাবে নিজস্ব লিঙ্গ নিয়ে লেখে ।

    ReplyDelete
  7. গভীরতা অনেক এই লেখার। বোধের আন্দোলন, মিশ্রিত আইডেন্টিটি আবার একটি পৃথক আইডেন্টিটি সবই ফুটে উঠেছে। বেশ কিছু জায়গা ভীষণ নাড়া দিল। ত্যাগের মধ্যে সোনার প্রতিফলন, পিয়ানোর বা ঘন্টার ধ্বনি আলাদা হয়ে যাওয়া উৎস থেকে এই কনসেপ্ট গুলো প্রবল নাড়া দিল। লেখককে অনেক ভালোবাসা। ❤️❤️❤️

    ReplyDelete
  8. অনেক ভালো লাগলো , অনেক শুভেচ্ছা জানাই । লেখাটা সঞ্চয়ে রাখলাম।

    ReplyDelete
  9. অসম্ভব ভালো লাগলো এই লেখাটা। তোমার ‌‌‌‌‌‌‌অনেক লেখা পড়ি এখানে, প্রতিটি লেখাই তোমার বড় ভালো লাগে, কিন্তু এই লেখাটার ভিতর যেন কিছু একটা আছে যা বারবার পড়তে বাধ্য করাল।

    ReplyDelete
  10. ভীষণ ভালো লেখা শতানীক । গদ্যটিতে প্রবাহ আছে বেশ । লেখাটা আগে পড়িনি । আজ পড়লাম । বেশ ভাল লাগল ।

    ।। শুভদীপ নায়ক ।।

    ReplyDelete