‘ফলের বাসনা, ফুলের কামনা,
পতঙ্গের লালা, বীজ ধারণের ইচ্ছা— এসব তো পুরুষের প্রার্থনা
নয়, মেয়েদের! স্বপ্নের কয়েদ থেকে আজ তোমাদের মুক্তি
পলিনোভা, ম্যাডোনা। যাও— দুই বোন আজ যুদ্ধের
পূর্বরাতে বেছে নাও নিজেদের স্থান, খুঁজে নাও যে যার প্রেমিক। শয়তানের
কারাগারে আজ একটিও প্রহরী নেই, পোশাক বদলে নাও, হাতে নাও আগুনের মশাল, সুন্দর মুখখানি ঢেকে নাও
কাপড়ে, অঙ্গে লুকাও ছুরি, শব্দ চিনে
চিনে আমার পিছনে এসো, এই রাতে বড় বেশি প্রয়োজন তোমাদের,
কে হবে সিংহাসনের শ্রেষ্ঠ উত্তরসূরি? এসো,
উপস্থিত হই রাজমহলের পিছনের দরজায়, দ্বার
খুলে একটু এগোলেই দেখবে নেমে গেছে সিঁড়ি, গোপন সুড়ঙ্গপথে
তোমরা দু’জনে চলে যাও মাটির নীচের ওই
শেষ
দুটি ঘরে। তোমাদের গর্ভে আসুক শিশু, সমগ্র গ্রিসের নিয়তি আজ নতুন করে জন্ম
নিক, সৈন্যসামন্ত আজ রাতে বিশ্রামে গেছে, এসো রাজকুমারীরা। আর কোনও বিলম্ব নয় এখানে, আর কিছুদিনের
মধ্যেই সরে যাবে সমস্ত নগরী। আমরা লোভের সন্তান, লোভেরই পুত্র
ক্রোধ বহুকাল আগে হিংসার কন্যাকে বিয়ে করে তাকে নতুনভাবে জন্ম দেয়, ভোর হবার আগেই তোমরা চলে এসো, আমি তোমাদের পুনরায়
পৌঁছে দেব শৃঙ্খলামুক্ত বেদনার কারাগারে।’
এ-কথা
বলেই অ্যানাক্সাগোরাস এগিয়ে গেল কারাগারের বাইরে যাওয়ার পথের দিকে। অ্যানাক্সাগোরাসের
পিছুপিছু রাতের অন্ধকারে কারাগার থেকে পালিয়ে যায় দুই বোন। মহামহিম সক্রেটিসের তখন
প্রায় যুবক বয়স। তিনি এথেন্সের রাজনীতির বিষয়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। অ্যানাক্সাগোরাস
তাঁকে বহুবার বুঝিয়েছেন মানুষের জ্ঞান ও প্রশ্ন করার ইচ্ছা হল খুব ভয়ংকর
জিনিস।
যা মানুষকে টেনে নিয়ে যায় তোলপাড় করা জীবনের মধ্যে দিয়ে। এই জ্ঞানের জন্যেই সে তাঁর
সুযোগ্য ছাত্র আর্কেলিয়াসকে হারালেন। প্রশ্নের মুখে পড়ে মানুষের সত্তা কম্পিত হয়, মানুষ সুখ
হারায়, সমৃদ্ধি হারায়, প্রেম ও সম্পর্কে
ফাটল ধরে, এমনকি তার বেঁচে থাকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তবু সক্রেটিস
নারাজ, এথেন্সের পথে পথে সে ঘুরে বেড়ায় জ্ঞান নিয়ে আলোচনা
করার জন্য, শিল্প-সাহিত্য-ভাস্কর্যকে প্রশ্ন করার জন্য।
২.
‘পলিনোভা, আমার অন্তরতমা,
তুমি এখানে? কারাগারের দুর্ভেদ্য দ্বার পার
করে কীভাবে এলে তুমি প্রিয়া?’
পলিনোভাকে হঠাৎ বন্দিশালার
দ্বারে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে সফোক্লিস।
‘সে
প্রশ্ন অবান্তর,
সব দ্বিধা কেটে গেছে আজ সফোক্লিস। তুমি বেঁচে আছ, আজ আমার ভিতরে গহিন তরঙ্গের গোপন দোলা লাগছে, আমার
করতলগত গোলাপ তুমি খুঁজে নাও। সফোক্লিস, তোমার স্পর্শলাভের
জন্যে এই হস্ত আমি প্রসারিত করি, আমার গা থেকে খুলে নাও রাজবিদ্রোহের
পোশাক, আমার শরীরকে আমি এক দৈব-আত্মার
সঙ্গে
যুক্ত করি! এসো, নিষিদ্ধ নেশার মতো এসে জড়িয়ে
ধরো আমাকে, তাতে আমি আশ্বস্ত হই, অন্যথায় ভনিতা করার অপরাধে
তুমি পুনরায় বন্দি হতে পারো। আমি মেয়েমানুষ, লোহার শিকল,
লোহার বেড়, গায়ে জড়িয়ে কী উপায়ে বাঁচব!
আমাকে তোমার বাহুযুগলের মধ্যে চিরতরে টেনে নাও।’
সফোক্লিস চিন্তিত
হয়ে পড়ল। বলল,
‘এমন দ্বিধার মুখে আমাকে ফেলো না প্রিয়া, কাল সকালেই
রওনা দিতে হবে, সৈন্যবহর বাইরে দাঁড়িয়ে। আজ শিবিরে শিবিরে
মদ্যপান নিষিদ্ধ, রমণী সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। প্রিয়া তুমি ফিরে
যাও। কেউ তোমাকে এই বিশ্রাম শিবিরে প্রবেশ করতে দ্যাখেনি তো? সঙ্গে অস্ত্র রেখেছ? আর বিলম্ব নয়, কার সঙ্গে তুমি এতদূর বিপদসঙ্কুল পথ পার হয়ে এলে?’
‘সে
ব্যক্তি আর কেউ নয়,
তিনি স্বয়ং সক্রেটিসের শিক্ষাগুরু অ্যানাক্সাগোরাস।’
‘আশ্চর্য! সেই মহাজ্ঞানী
মানুষটা। যাও তাঁকে গিয়ে বলো থুকিডিডিসের জন্ম হয়েছে। জন্মমাত্র তাঁকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে
আজীবন দাসত্বের নির্বাসনে। তাঁকে তুমি অনুরোধ করো থুকিডিডিসকে খুঁজে আনতে। সেই রচনা
করবে গ্রিসের দীর্ঘ অঘোরী ইতিহাস।’
‘থুকিডিডিস
ফিরবে সখা, সে তার সময় হলে ফিরবে। অ্যাম্ফিপিলিস
ফেলে সে সর্বত্র ঘুরে বেড়ালেও এখানেই তাঁর জন্ম, স্পার্টা
ও এথেন্সের যে সর্বনাশা যুদ্ধ ক্রমশ এগিয়ে আসছে, তাঁকে লিখতে
হবে সেই যুদ্ধের ইতিহাস, আমাদের যুগল-প্রেমের ইতিহাস, তবে এখনই নয়। আজ আমি ফিরে যেতে
প্রস্তুত নই রাজাধিরাজ, আজ আমি আদর চাই, অন্তরঙ্গ রাত্রিটুকু শুধু তোমার আলিঙ্গনে
ভিজতে
চাই। সফোক্লিস,
তুমি হবে আমার সন্তানের পিতা!’
পলিনোভার লালসাময়
চোখের দিকে ফিরে তাকায় সফোক্লিস। সে বীর, আবার একইসঙ্গে যোদ্ধা ও নাট্যকার।
তাঁর নিজের কোনও নাটকের চরিত্রে এমন রমণীর কথা সে এখনও লেখেনি।
পলিনোভা প্রগলভ হয়ে
বলতে থাকে, ‘দ্বারের
ওপাশে জ্বলুক মশাল,
এই ঘর ভেসে যাক আচ্ছন্ন অন্ধকারে, নেভাও
ঘরের জ্বলন্ত মশাল, আজ আমি মাতাল, উতলা, লোভাতুর রাক্ষসী, আজ আমার সর্বস্ব তোমার।’
৩.
‘বাইরে নিস্তব্ধ রাতের
বিচ্ছুরণ, কাল প্রভাতেই আমাদের রণতরী যাত্রা করবে, আমি তোমার
সর্বাঙ্গসুধা নিয়ে যেতে চাই’ ম্যাডোনাকে বুকে জড়িয়ে শান্তস্বরে
বলল ইউরিপিডিস। সে জানত এসকাইলাসের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ক্রমশ বেড়েছে, এবং সেটা
যে ইউরিপিডিসের জন্য, তা ম্যাডোনার প্রণয়াসিক্ত চোখ দেখলে
সহজেই বোঝা যায়।
‘সুধা! প্রাণনাথ,
তেমন সৌরভ আছে বুঝি আমার অন্তরে? আমার শরীরে?
এতকাল তোমার স্মৃতির অনলে দগ্ধ ছিল আমার প্রাণ, আজ তার মুক্তি ঘটল। দিকে দিকে পাখি উড়ে যায়, সরোবরের
জলে আজ এত কম্পন, এত মায়া, আমি পূর্বে
কখনও টের পাইনি। অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে বুঝেছি, ভালবাসাই
হল সব নির্মাণের পূর্বশর্ত। এই তরবারির সূচ্যগ্র ফলা, এর সম্মুখে
অপেক্ষারত কত কত নিবেদিত প্রাণ। হে প্রেমজাগানিয়া, তোমার অর্জনই
তোমার প্রাপ্য!’
হঠাৎ গভীরভাবে ইউরিপিডিসকে
জড়িয়ে ধরল ম্যাডোনা। মেলিটি, ইউরিপিডিসের প্রথমা স্ত্রী, যিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন ইউরিপিডিসের সঙ্গে। ক্ষমতা ও রানি হওয়ার উচ্চবাসনা
থেকে তিনি মেলামেশা শুরু করেন এথেন্সীয় রাজবংশের যুবরাজের সঙ্গে। এথেন্সের
রাজবংশ ইউরিপিডিসকে,
তাঁর লেখা নাটককে কখনও মর্যাদা দেয়নি। গ্রিক রমণীরা একইসঙ্গে দেবী
ও রাক্ষসীর স্বভাব ধারণ করে নিজেদের অন্তরে। মেলিটির প্রত্যাখ্যান
ইউরিপিডিসকে তীব্র হতাশায় পর্যবসিত করে এবং সে লিখতে শুরু করে। এবং তাঁর লেখার প্রেমে
পড়েই ম্যাডোনা প্রস্ফুটিত হয়। একইসঙ্গে ম্যাডোনা হোমারের লেখা পড়েও জারিত হতে থাকে।
ম্যাডোনা বলতে থাকে, ‘তোমাকে ভালবাসতে ইচ্ছে
করছে ইউরিপিডিস। তুমি কবি,
তুমি স্রষ্টা, তুমি সমস্ত গ্রিসের রক্ষক,
আমি তোমার প্রণয়সাধিকা, কোনও স্বর্গের দেবী
আমি
নই, আমি সাধারণ এক মর্ত্যভ্রষ্টা নারী।’
ইউরিপিডিস শুনতে থাকে।
বলে, ‘বহুদিন
আমি পলাতক ছিলাম,
ভেবেছিলাম তোমাকে ও তোমার সহোদরাকে বুঝি হত্যা করা হয়েছে। এক রাতের
অন্ধকারে সক্রেটিস আমাকে এই বার্তা দিলেন তোমরা দুই বোন এখনও জীবিত।’
‘হ্যাঁ, প্রাণনাথ!
এথেন্সের স্বর্ণখনির মধ্যে আমরা দুই বোন বন্দি ছিলাম, কেবল থুকিডিডিস পালাতে পেরেছিল। স্পার্টারা দখল করে
সেই খনি, বিশ্বাসঘাতক ব্রাসিডাস, সেই-ই আমার বোন পলিনোভার সম্ভ্রম নিতে চেয়েছিল, তাকেই
হত্যা করার চেষ্টা করি আমি। বোধকরি থ্যাসস দ্বীপেই গিয়েছে থুকিডিডিস, ইউক্লিস তাকে নিয়ে গেছে। মহামহিম অ্যানাক্সাগোরাস
কি সেই কথাটা গোপন করলেন আমাদের কাছে?’
ইউরিপিডিসকে বিছানায়
ফেলে রেখে উঠে বসে ম্যাডোনা। তাঁর মনে একটি নারীকে নিয়ে বিস্ময় জাগে। সে মেয়ে চায় ইউরিপিডিসকে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতে। কিন্তু সেই কিশোরী শওরিনের কতটুকু বা
বয়স? সবে তাঁর শরীরমনে একফোঁটা যৌবনের রং লেগেছে। চোখেমুখে
শৈশবের চাঞ্চল্য কেটে গিয়ে যৌবনের আভা লেগেছে। কিছুদিন আগেও সে নাকি জানিয়েছে, সে সমুদ্রতীরে
বসে
ঝিনুকের মালা গাঁথছে ইউরিপিডিসের গলায় পরাবে বলে।
ম্যাডোনাকে চিন্তিত
দেখে ইউরিপিডিস বলল,
‘একটা কথা অবশ্য শ্রুতিগোচর হয়েছে রাজকুমারী, থুকিডিডিস কি হোমারের কল্পনাজালের বিরোধী?’
হোমারের নাম শুনতেই
একটা প্লাবন এল ম্যাডোনার চোখেমুখে। মেয়েদের মনে অনেক পুরুষের নাম তোলা থাকে। কিন্তু
স্বপ্নের মতো সেইসব নাম তাদেরকে একটা সময়ের পর ভুলতে হয়। তবু, মেয়েদের মন
প্রতিবারই অজস্র ভুলে পা দেয়। ম্যাডোনা বলে, ‘আহা! হোমারই ফুটিয়েছে
আমাকে নারীরূপে। এ কী মহৎ মহিমা রাজাধিরাজ, সকল মেয়েরা পারে
না, কদাচিৎ কেউ কেউ বাদে, বাকি সকল
মেয়েরা পারে না নারী হয়ে ফুটে উঠতে। হোমার আমাকে ফুটিয়েছে, অ্যাকিলিসের প্রিয়তমা রানির গর্ভে আমরা যেন দুই বোন পাশাপাশি ফুটেছি। থুকিডিডিস
কী চায়?’
‘হে
প্রিয়া, থুকিডিডিস চায় সমগ্র ইতিহাস গদ্যে বর্ণিত করতে। কাব্য ছাড়া, পঙ্ক্তি ছাড়া, কেমন ভাবে
আমরা বাঁচব সেই নিষ্ঠুর গদ্যে? হিপোক্রেটিস, সফিস্টের
শিক্ষাগুরু প্রোটাগোরাস ও আমাদের পণ্ডিত সক্রেটিস চায় থুকিডিডিসের মধ্যে বস্তুনিষ্ঠা
সংক্রামিত করতে!’
ইউরিপিডিস কথাগুলো
বলতে বলতে উঠে যায় বিছানা থেকে। ঘরের এককোণে রাখা পাথরের গ্লাসে ঢেলে নেয় সুরা। তারপর
ফিরে এসে বিছানায় বসে থাকা অর্ধউলঙ্গিনী ম্যাডোনার খোলা চুলে হাত দেয়।
ম্যাডোনা বলে, ‘কিন্তু রাজাধিরাজ, প্রভাতেই
তুমি রওনা দেবে যুদ্ধে, যদি না ফিরে আসো, তবে তোমার প্রত্যাশিতা কলঙ্কিতা প্রেমিকা তোমার ঔরসপ্রাপ্ত দেবশিশুটিকে
নিয়েই সমস্ত জীবন কাটিয়ে দেবে। এ-শরীর, এ-মন
অন্য কোনও পুরুষের চর্চিতা কখনওই হয়ে উঠবে না।’
‘যাঁর
অভিশাপে আমার মধ্যে রুদ্রকাম প্রবেশ করেছে, তুমি তাঁরই উপাসনা করো শুনলাম। সেই
উলঙ্গিনী আফ্রোদাইত, সেই অদ্ভুত সুফলা সুন্দরী,
সেই পাপিষ্ঠা যুবতি,
তোমরা
দুই বোন তাঁরই ব্রত পালন করছ শুনলাম। তাঁকে আমি শুধু একটিবারই দেখেছি পেরিক্লিসের রাজসভায়
চিত্রকরের নির্মিত এক তৈলচিত্রে। সেই বিষাক্ত সুন্দরী, চক্ষু ভরা
অবদমিত ক্ষুধা যার, সেই নারী, সেই-ই আমার মধ্যে চালনা করেছে নারীর প্রতি বাসনা, আদিম
আকাঙ্ক্ষা।’
‘হ্যাঁ, মহামহিম।
আমাদের দেবী,
সমস্ত গ্রিক শিশুদের স্তন্যদায়ী সেই ঐশ্বরিক রমণী, যিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিয়েছেন পুরুষের
বুকের গভীরে, তাঁর প্রসাদি গরলে আমরা দুই বোন হয়ে উঠেছি
ঋতুমতী।’
‘কী
চায় সেই যুবতি?
যিনি মমতায় মানবী, ক্ষমতায় ঈশ্বরী,
লোভে পূর্ণাঙ্গ রাক্ষসী, কী চায় সে?’ অস্থির
হয়ে জিজ্ঞেস করে ইউরিপিডিস।
ম্যাডোনা তাকিয়ে থাকে
মেঝের দিকে। বলে,
‘ভয়াবহ যুদ্ধ! যুদ্ধ লুকিয়ে থাকে মানুষের শরীরে,
অন্তরে, ক্ষুধায়, ক্রোধে। ইউরিপিডিস, তুমি গ্রিসের ভূমিপুত্র। আমার
বিমুগ্ধ স্তন দু’টি গ্রহণ করো ঠোঁটে, আমার জীবন
শূন্যতায় ভরা, সুরাসক্ত হৃদয়ের খোঁজে নিবৃত্ত হও এবার,
আমি চাই শিশু। দেবীর কৃপায় নয়, তোমার প্রেমে।
এতটুকু বিশ্বাস আমার ওপরে তুমি রাখতে পারো, জীবন দিয়ে
যাকে আমি পাইনি, ছল করে তাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা এ জীবনে কখনও
করব না।’
৪.
‘চারিপাশে পরিব্যপ্ত
অন্ধকার, তুমি কি শুনতে পাও পলিনোভা? এই আমার বুক,
স্পর্শ করো তুমি। হ্যাঁ, ওই বাঁ-দিকেই,
ওখানেই লুকানো আছে হৃদয়, ক্ষুধার সমাধি,
প্রেমের চিহ্ন।’
পলিনোভা চোখ বন্ধ
করে সফোক্লিসের বুকে মাথা রাখে। বলে, ‘সফোক্লিস, তুমি বীর,
তুমি যোদ্ধা, যেসব নাটক তুমি লিখেছ,
তাতে লড়াই করেছ নিজের সঙ্গে। কোমরে অসি ও বাহুযুগলে সুশোভিতা রমণী
মানায় তোমাকে। তুমি জন্ম থেকেই মাতৃহারা, পেরিক্লিসের মা তোমাকে
নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছেন। আমি তোমার চেয়ে জন্মে বড় হলেও, তুমিই মৃত্যুতে আমার চেয়ে বড় হবে। এই যুদ্ধ তোমার কাছে ভ্রাতৃহত্যার স্বরূপ
হতে পারে, কিন্তু এমনটা হোক আমি কিছুতেই আর তা চাই না। মহামহিম
সক্রেটিসের কাছে যতদূর শুনেছি, তুমি ছিলে লুসেনার কানীন পুত্র।
হ্যাঁ, সফোক্লিস, তুমি থিবীয় বংশজাত।
তোমার মা এক রাত্রে ছুরিকাবিদ্ধ হয় প্লেটীয়দের হাতে। এথেন্সীয়
রানির
কাছে এসে সে তোমায় রেখে মারা যায়। তোমাকে রাখা হয় আফ্রোদাইতের পায়ের কাছে।
সেই থেকে তোমার ওপর লোভ কালসর্পধারিণীর।’
‘পলিনোভা, আমার প্রিয়তমা,
তুমি তো তাঁরই অর্চনা করো, তাঁকেই গ্রিসের
পরমেশ্বরী রূপে আরাধনা করো।’ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে সফোক্লিস
বলল।
‘হ্যাঁ, পারস্পরিক
সৌহার্দ্র্যে সকল রমণীই পরস্পরের প্রতি সৌজন্যে ভূষিতা, কিন্তু
তাদের প্রত্যেকের অন্তর বড় রক্তপিপাসু। আফ্রোদাইতের কবল থেকে এই
আমি তোমাকে ছিনিয়ে নিলাম। আমার পিতা ছিলেন প্লেটীয় বংশজাত, মা ছিলেন
থিবীয়। আর্গস ও অ্যাকিয়া ছিল নিরপেক্ষ, তারা স্পার্টাদের
পক্ষেও ছিল না। শুধু পেলেনিই প্রথম যুদ্ধে যোগদান
করে, যা আসলে অ্যাকিয়ার রাষ্ট্র ছিল। ঝড়ের রাত্রে সমুদ্রে প্রেরিত জাহাজে আমার
মায়ের আহ্বানে আমার পিতা দীর্ঘ সামুদ্রিক সঙ্গমে মিলিত হয়। না, এ কোনও আকস্মিক
ঘটনা নয়, আমার মা ছিলেন আমার পিতার বন্ধুপত্নী, পরস্ত্রী। অগ্নির প্রজ্জ্বলিত শিখার ডাকে ধাবমান পতঙ্গের মতোই আমার পিতা
প্রবলতর সেই বণিকপত্নীর প্রেমে সাড়া দিয়েছিলেন। অতঃপর
তিনি নিহত হন এথেনীয় রানির সৈনিকদের হাতে। হ্যাঁ, তোমার বিমাতাই আমার পিতৃহত্যার
ঘাতক।’
‘না, না,
না, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না। কী নিষ্ঠুর!
কী বিশ্রী! আমি এ-কথা
কিছুতেই বিশ্বাস করি না প্রিয়তমা।’
‘শান্ত
হও সফোক্লিস। তুমি যোদ্ধা,
লেখক। তুমি সত্যদ্রষ্টা। সক্রেটিসের
সঙ্গে মহামহিম অ্যানাক্সাগোরাসের কাছে তুমি শিক্ষা নিয়েছ, যোদ্ধাদের
সহপাঠী ছিলে, তোমাকে অসিবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছেন
তোমারই বিমাতা। এখন তার পুত্রকেই আমার গর্ভে জন্ম দিতে হবে রাজবংশীয় সন্তানের।’
গভীর একটা সন্দেহ
প্রকাশ পায় সফোক্লিসের দু’ চোখে। পলিনোভার দিকে তাকিয়ে সে
প্রশ্ন করে, ‘তাহলে
ম্যাডোনা কার কন্যা?
তোমরা তো সহোদরা ছিলে?’
‘নিশ্চিত
তাই আছি, আমাদের পিতার পরিচয় পৃথক, কিন্তু আমরা দুই বোন
একই রত্নগর্ভার সন্তান।’
চঞ্চল হয়ে ওঠে সফোক্লিসের
মন। বলে, ‘কেমন
করে তা জানতে বড় সাধ হয়!
তুমি আমাকে সব কথা বলো প্রিয়া, যতই তা নিষ্ঠুর
হোক। আর বিলম্ব কোরো না। নির্দ্বিধায় অকপটে স্বীকার করো তোমার সত্যিটুকু।’
পলিনোভা বলে, ‘আমার সমস্ত সত্যিটুকু
হলে তুমি। সেই অস্ত্রচালনার দিনে তুমি ছিলে প্রবল কিশোর, আমি ছিলাম
তোমার চেয়ে বছর কয়েকের বড় যুবতি, আমার স্তনে তখন গুটি বেঁধেছে, চোখে পড়তে
শুরু করেছে মানুষে-মানুষে পার্থক্য। আমি তৈরি হচ্ছিলাম
শরীরমনে। কী উপায়ে,
কী আশায়, তোমার স্পর্শসুখ, তোমার দৃশ্যবাসনা ইন্দ্রিয়লব্ধ করা যায়— এই ছিল আমার মনে।
আমার প্রাণ ভাঙতে লাগল,
সমস্ত সত্তা চিৎকার করে কেবলই তোমার কামনায় বিভোর করে তুলল আমাকে।
আমার মা চাইতেন আমি তোমার দিকে ধাবিত হই। তোমার পৌরুষছায়াতলে বাড়ুক আমার বিস্তৃত বিবর্ধিত
যৌবন। বহু পুরুষ আসতে লাগল আমার জীবনে, চাইতে লাগল
আমায়। কেবল তুমিই এলে না। প্রার্থিতপুরুষ, পরমপুরুষের এমন
অনাদরে প্রতিজ্ঞা বাঁধলাম আফ্রোদাইতের কাছে। তোমার আত্মার একাংশ
আমি তাঁকে দেব,
যদি আমি তোমাকে ছুঁতে পারি, তোমাকে আমার
স্তনবিভাজিকাতলে নিদ্রাভূত করতে পারি। আমার মনের এরূপ ত্রিশঙ্কু অবস্থা দেখে আমার মা
আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, আমি আমার পিতৃহত্যার ঘাতকের পরমপুত্রটির
প্রেমে পড়েছি। এক রাত্রে চুলের গাছি বেঁধে দিতে দিতে তিনি বললেন— আমার জীবন
থেকে শিক্ষা নাও পলিনোভা। তুমি ম্যাডোনার ভগ্নি, আমার কনিষ্ঠা কন্যা তুমি। সর্বোপরি
এখন তুমি যৌবনাসক্তা নারী। শত্রুশিবিরে কখনও প্রণয়ের গিঁট বাঁধা যায় না। পরমপুরুষ যদি
পরপুরুষও হয়, তাহলেও তার দিকে মন বাড়িয়ো না, নারীকে আপন মন বাঁধতে হয়। শরীরমনের সমস্ত ঢেউ সবক’টি
প্রলয়কে আজ শান্ত হতে বলো,
নইলে অনর্থ হবে...’
সফোক্লিস এক বিমুগ্ধ
বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে পলিনোভার দিকে। পুরুষের আত্মার প্রতি মেয়েদের প্রেম ঠিক কতটা গোপন
ও কতখানি লোভের তা আজ সে বুঝতে পারে। পলিনোভা তাকে অতীতে কিছুই জানতে দেয়নি এ ব্যাপারে।
আজ যুদ্ধযাত্রার পূর্বরাতে সে এই সত্যিটুকু জানতে পেরেছে, সে পিতৃসূত্রে
এথেন্সের কেউ নয়। সে পলিনোভাকে প্রশ্ন করে, ‘তাহলে কেন তুমি আমার
প্রতি প্রণয়াসক্ত হলে প্রিয়া? যুদ্ধ থেকে আমি যদি জীবিত না ফিরি, তাহলে তুমি তোমার গর্ভস্থ সন্তান নিয়ে কীভাবে সমস্ত জীবন কাটাবে?’
‘এ
আমার পরিণতি যুবরাজ। মনে করো, এটাই আমার পিতৃহত্যার সবচেয়ে গূঢ়তম প্রতিশোধ।
অথবা আমার বহুজন্মের ভালবাসার ফসল।’
‘আর
তবে শেষ প্রহরে কোনও কথা নয়, আমাকে তোমার অখিল শুশ্রূষাটুকু গ্রহণ করতে দাও
প্রিয়া।’
৫.
থুকিডিডিস ফিরে আসে সক্রেটিসের
আমন্ত্রণে। এথেন্সের অন্যতম নেতা ক্লিয়ন তাঁকে নির্বাসন দেন। তাঁর
বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অ্যাম্ফিপলিস রক্ষার চেয়ে থ্যাসাসে বসে তিনি পৈতৃক স্বর্ণখনি সামলাতেই
ব্যস্ত। গ্রিকরা এই সময় সোনার বাণিজ্য শুরু করেছিল। বাইজানটাইন সভ্যতার শুরু থেকে
সোনার বিনিময়ে যুদ্ধের অস্ত্র কেনা একরকম রীতি হয়ে দাঁড়ায়। থুকিডিডিসের জন্ম উত্তর-পূর্ব গ্রিসে
স্বর্ণখনির মালিক অলোরাসের ঔরসে। রাজা ইউক্লিসের ডাকে তিনি একবার অ্যাম্ফিপলিসে এসেছিলেন,
কিন্তু ততদিনে অ্যাম্ফিপলিসের পতন হয়ে গেছে। সেসময় তিনি কুড়ি বছরের
যুবক, সক্রেটিস মাত্র বারো বছরের বড় তাঁর চেয়ে। পরবর্তীতে
আমরা
দেখব, ক্লিয়ন
তাঁকে নির্বাসন দেন বিখ্যাত পেলোপনেসীয় যুদ্ধের আগে। সকল ইতিহাসপ্রেমী আজ ক্লিয়নের
কাছে
কৃতজ্ঞ, নির্বাসনের মাধ্যমে থুকিডিডিসের প্রাণ বাঁচানোর জন্য। বলা বহুল্য,
পৃথিবীর মহৎ গ্রন্থগুলো রচিত হয়েছে লেখকের নির্বাসন কিংবা বন্দিদশায়।
সক্রেটিস এথেন্সে বসে জানতে পারলেন থুকিডিডিস সেখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে। এসকাইলাস তাঁর
সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রাখছে। তিনি থুকিডিডিসকে ডেকে পাঠালেন এসকাইলাসের মাধ্যমে।
‘গুহার
দ্বারে পত্রমর্মর শব্দ শুনেই টের পেয়েছিলাম আপনি এসেছেন। মহামহিম, এ-পথে
আসতে আপনাকে কেউ লক্ষ করেনি তো।’ সক্রেটিসকে দেখতে
পেয়ে থুকিডিডিস বলল।
‘কেউ
যদি আমায় দেখে থাকে তো আমি তার পরোয়া করি না। থুকিডিডিস, তুমি এথেন্সের
সৈন্য ও স্পার্টাদের গুপ্তচরদের নজর এড়িয়ে এখানে থেকে গেছ। এ-জন্য
তোমায় ধন্যবাদ। আমি এইমাত্র অ্যানাক্সাগোরাসকে বলে এলাম, সে যেন দুই রাজকুমারীকে তাঁদের প্রেমিকের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসে। আজ গ্রিসের
নরনারীদের মহামিলনের রাত।’
গুহার পাথরের দেওয়ালে
একটা শিলায় চিড় ধরা ছিল,
সেখানে হাতের জ্বলন্ত মশালটা গেঁথে দিয়ে কথাটা বলল সক্রেটিস।
‘যথার্থই
মহামহিম। গ্রিসে চাই নবজন্মের শিশু। কিন্তু সিংহাসন নিয়ে এথেন্সের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব
থাকবেই।’
‘চিরকালই
ছিল থুকিডিডিস,
তেমনটা চিরকালই ছিল। আমার পূর্বে অনেকেই যখন এ-দেশে
জ্ঞান সংগ্রহ করে ফিরছিলেন, তারাও লোভের সাক্ষাৎ পান, যৌনতার আমন্ত্রণ পান, হিংসাকে স্বচক্ষে লক্ষ করেন।
যেখানে দ্বন্দ্ব নেই, সেখানে সভ্যতা নেই। থুকিডিডিস,
তুমি সত্য লিখবে। এই ভয়ংকর যুদ্ধের পূর্বরাতে, আমাকে কথা দাও।’
থুকিডিডিস হাঁটু গেঁড়ে
বসল সক্রেটিসের পায়ের কাছে। একটা প্রস্তরখণ্ডের ওপর বসে সক্রেটিস জল খাচ্ছিলেন। থুকিডিডিস বলল, ‘আপনার
কাছেই শিখেছি, সত্য বড় নিষ্ঠুর, তবে তা পৃথিবীর বিচারে সহায়ক।’
সক্রেটিস খুব হতাশ, খুব ক্লান্ত
ছিলেন। প্রস্তরখণ্ডের ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বোধকরি তোমাদের মতো
মানুষদের সঙ্গে জ্ঞানের আলোচনায় আমি রাষ্ট্রের কাছে দোষী সাব্যস্ত হয়েছি। আমি মানুষের
কাছে প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছি। দেখেছি, তারা যুক্তির পরিবর্তে প্রাপ্য উত্তরেই
বিশ্বাসী। আমাকে তারা অহেতুক জ্ঞানী মনে করে। এথেন্সের মানুষ তাদের ব্যক্তিগত জীবনে
মৃত হয়ে আছে, নারীরা যৌনতা অবদমিত করে রাখছে, পুরুষেরা নারীদের খর্ব করে রাখছে। এ বড় বিশ্রী
দেশ।
এ দেশের প্রতিটি মানুষ মৃত্যু পরবর্তী দশা নিয়ে ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত। তুমিই পারো
এই যুদ্ধের
ইতিহাস রচনা করে সবটা বদলে দিতে।’
‘কিন্তু
মহামহিম, আমি কি হোমারের কল্পনাজালের বিরোধী হয়ে উঠতে পারব?’ থুকিডিডিস
উঠে দাঁড়িয়ে বলে।
সক্রেটিস তাকে বসতে
বলেন পাথরের খণ্ডটির ওপর। বলেন, ‘তোমাকে পারতে হবেই
থুকিডিডিস। ভয় থেকে মুক্তিই হচ্ছে সুখ। জ্ঞানের কর্তব্য হল মানুষের মনকে এই ভয় থেকে
মুক্ত করা: ধর্মের ভয়, দেবতার ভয়, লালসার ভয়, মৃত্যুর ভয়।’
‘আর
ওই দেবী আফ্রোদাইত? তাঁর অবদমিত
যৌনতাকে আপনি সমর্থন করেন মহামহিম?’
‘আফ্রোদাইত
চিরকালই স্বয়ংসম্পূর্ণা অথচ তৃষ্ণার্ত এক নারী। সে নিজেই কামপূর্ণ। তাঁর কখনও পুরুষের
প্রয়োজন পড়ে না। আর তাই সৃষ্টির অভিশাপে সে কখনওই পুরুষসঙ্গ পেল না। সেই অতৃপ্ত বাসনা
সে প্রতিটি গ্রিক নারীর মধ্যে সঞ্চারিত করে, তাদের মধ্যে দিয়েই সে খুঁজে চলে পুরুষ।’
‘কেমন
করে আমার জ্ঞান লাভ হবে মহামহিম? যে জ্ঞানে আমি লিখতে পারব গ্রিসের শাশ্বত সত্য!’ আজ্ঞাবহের
মতো জিজ্ঞেস করে থুকিডিডিস।
সক্রেটিস বলতে থাকেন, ‘জ্ঞান
সম্পর্কে আমি নগরে-নগরে ঘুরে বেড়িয়ে প্রায় সকলকে প্রশ্ন করেছি। প্রায় কেউই
আমার কৌতূহল আর জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে পারেনি। দিনের শেষে আমি ক্লান্ত হয়ে ফিরেছি আমার
কুটিরে। আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, এতসব জ্ঞানীর সঙ্গে আমার মতো মূর্খের
যদি কিছু পার্থক্য থেকে থাকে, তবে তা হল এই, আমি জানি যে আমি কিছু জানি না, কিন্তু এরা জানেই
না যে এরা আসলে কিছুই জানে না।’
থুকিডিডিস বলে, ‘তাহলে মৌলিক জ্ঞান
সম্পর্কে কিছুই আমাদের বস্তুগত নয়, কেবল ভাবেই তার সম্প্রসারণ?’
‘হ্যাঁ, একরকম করে
তাই-ই। বিশ্বের মূলসত্তা সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে না। জ্ঞান
তাই মনের বাইরের কোনওকিছু নয়, ব্যক্তির নিজের মধ্যেই জ্ঞান
রয়েছে। প্রকৃত শিক্ষকের কাজ ধাত্রীর দেহ থেকে সেই জ্ঞানশিশুকে বের করে আনা এবং তাকে
দেখানো যে, এটা তার মধ্যেই ছিল। প্রশ্ন, জবাব, পুনরায় প্রশ্ন, এভাবেই ব্যক্তির মধ্যে যে অসঙ্গতি আছে, তা স্পষ্ট
হবে। অসঙ্গতি ও মিথ্যাকে বাদ দিয়ে যে সত্য জ্বলে উঠবে, সেইটাই
হল জ্ঞান, ব্যক্তির শাশ্বত উপলব্ধি।’
কথাগুলো বলে সক্রেটিস
উঠে দাঁড়ায়। থুকিডিডিস ও সক্রেটিসকে ধরে আনার জন্য লোক পাঠিয়েছে রাজা। শুভাকাঙ্ক্ষীরা
কেউ কেউ সক্রেটিসকে বলেছেন তিনি যেন এথেন্স থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু সক্রেটিস সত্যপ্রতিষ্ঠায়
দৃঢ়বদ্ধ। তিনি জানেন কর্তব্য ও ব্যক্তিগত সত্তা ফেলে পালিয়ে গিয়ে এই পৃথিবীর কোথাও
আরোগ্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।
‘তাহলে
আমার এখন কী কর্তব্য মহামহিম?’ থুকিডিডিস জানতে চায়।
‘তুমি
এখান থেকে, সমগ্র এথেন্স থেকে পালাও থুকিডিডিস। নির্জন দ্বীপে চলে যাও। সেখানে বসে
রচনা করো গ্রিসের নিয়তি। কাল প্রভাতে এই গুহায় সৈন্যরা আসবে। তোমাকে না পেয়ে তারা আমায়
ধরে নিয়ে যাবে। আজ রাত্রিশেষে তুমি সমুদ্রতীরে দেখতে পাবে একটি ভাসমান নৌকা। তাতেই
চড়ে সমুদ্র পার হবে তুমি ছদ্মবেশে।’
থুকিডিডিস চুপ করে
থাকে।
সক্রেটিস বলেন, ‘কাল
প্রভাত থেকেই যুদ্ধের সূচনা হবে। কালই আমায় বন্দি করা হবে। ইউরিপিডিস ও সফোক্লিস কাল
রওনা দেবে অস্ত্র ও লেখার সরঞ্জাম নিয়ে। পথের নৃশংসতা, যাত্রার বীরত্ব,
অপ্রস্তুত প্রেম তারা লিখবে নিজের খেয়ালে। তাদের দুই প্রেমিকা,
যাদের গর্ভে গ্রিসের যোগ্য উত্তরসূরিরা লালিত হবে, সেই দুই নারীকে
বাঁচানোর দায়িত্ব থাকবে অ্যানাক্সাগোরাসের ওপর। তুমি আর বিলম্ব কোরো না থুকিডিডিস,
যাও।’
থুকিডিডিস বলে, ‘যথা আজ্ঞা মহামহিম।
কিন্তু এথেন্সে যদি ফেরত না আসতে পারি, তবে আপনার পরবর্তী শিষ্য কে
হবে?’
মশালের দিকে তাকিয়ে
সক্রেটিস উত্তর দেয়, ‘প্লেটো।
সে জন্ম নেবে আর-এক রাজকুমারী পেরিকটিওনের গর্ভে, কানীন পুত্র
রূপে।’
ঠিক তার পরদিন ভোরে
থুকিডিডিস এথেন্স ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে তিনশো জনের একটি থিবীয় সৈনিকের
দল নৌক্লাইডিসের আমন্ত্রণে অ্যাটিকাতে প্রথম আক্রমণ করে এবং যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
এই গল্প পাঠ একটা অভিজ্ঞতা৷ যেন সমগ্র পাণ্ডিত্যকে সহজিয়া কড়াইয়ে ভাজা হয়েছে।। যেন আমাদের অর্থাৎ মানবজাতির আবহমান যুদ্ধ প্রেম লোভ যৌনতা একটা মলায় গাঁথা হয়েছে৷ আর ভাষা যেন ভরে যাওয়া মৌচাক- প্রীতম বসাক
ReplyDelete