বাক্‌ ১৪০ ।। আমার সফর ।। দূর্বাদল মজুমদার



প্রথম পর্বের ওড়িশা ট্রেনিংক্যাম্প শেষ হলে আমরা যে যার এরিয়ায় (তিরিশ-চল্লিশটা গ্রাম নিয়ে একটা এরিয়া কমিটি গঠিত হত) ফিরে এলাম।

         আমার এরিয়া ছিল পশ্চিমবঙ্গের গোয়ালতোড়-সারেঙ্গা-সিমলাপাল তিনটে থানার বর্ডার এরিয়া।আমি ও আমার তৎকালীন গুরু সুমিতদার সাথে ভাগ করে নিয়ে কাজ করতাম। এছাড়া বিশেষ কারণ থাকলে পাশের কমরেডদের এলাকায়ও ডাক পড়ত। এরকম বিভিন্ন এরিয়া ছিল মূলতঃ এক-একজন সংগঠকের আন্ডারে।

          এরিয়াগুলো কীভাবে গড়ে উঠল, সে ইতিহাসটা একটু আলোচনা করা যাক। 
        ৭০এর দশকে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠলে জঙ্গলমহলের জেলাগুলোও প্রভাবিত হয়।মূলতঃ গোপিবল্লভপুর ও ডেবরা-বালিচকের কৃষকদের সংগঠিত করে সন্তোষ রাণা,রনবীর সমাদ্দার প্রমুখেরাা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের কৃষক ও খেতমজুরেরা  ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন।

         যাইহোক যুক্তফ্রন্ট ও তারপরে সিপিএম নেতৃত্বের বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গের নকশালপন্থী আন্দোলন থিতিয়ে যায়। সিপিআই এম এল ভেঙে গিয়ে নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।  কিন্তু তার আগুন  ছড়িয়ে পড়ে ঝাড়খন্ড ছত্তিশগড় অন্ধ্র দণ্ডকারণ্যে। 

          আবার গোটা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কোথাও কোথাও বিভিন্ন মানুষের নেতৃত্বে ছোট ছোট এলাকায় সংগঠনের কাজ চলতেই থাকে। আমার এলাকায় শংকর চ্যাটার্জী নামে এক কমরেড আশির দশকে এরকমই একটি আন্দোলন সংগঠিত করতে চেষ্টা করেন। তাঁর নেতৃত্বে অমিয়-কুন্ডু, কেবল দুলে (এনারা আমার সময়েও কাজ করেন ও পরে ২০০১ সালে গ্রেফতার হন), পবন মাহাতোরা এলাকার কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, কোন গণআন্দোলন গড়ে না তুলে, পুলিশের বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়ার মতো হঠকারী ঘটনায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার হলে এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এইসময় এমসিসির নেতৃত্বে বেলপাহাড়ি-বারিকুল-রাণীবাঁধ এলাকায় কমরেড রাজেন মুর্মুদের নেতৃত্বে এমসিসি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 

          আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের শুরুতে গড়বেতার অদূরে মসিনাপুর (বিষ্ণুপুর ব্লক)-এ কয়েকজন মানুষের নেতৃত্বে আরো একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের  একজন পরবর্তীকালে লালগড় অঞ্চলে কাজ করেছেন আমাদের সাথে। আবার আরো পরে তৃণমূল দলে যোগ দিয়ে লালগড় আন্দোলনকে কবরে পাঠিয়ে মাওয়িস্ট-নেতাদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে এখন বিখ্যাত নেতা হয়ে বসেছে।                      

             এরপর আসে নয়ের দশক ও তৎপরবর্তীকালের আন্দোলন, যার সামান্য অংশীদার ছিলাম আমি।

           নয়ের দশক ছিল রাজনৈতিকভাবে স্বপ্নভঙ্গের দশক। যে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসে, একদশক যেতে না যেতেই তাদের ব্যুরোক্রেটিক ও সামাজিক-ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর রূপটি জনসমক্ষে বেরিয়ে আসে। পার্টিতে ব্যাপক লুম্পেনাইজেসন শুরু হয়। গ্রামাঞ্চলে কেউ গুন্ডাটাইপের বা ডেসপারেট গোছের হয়ে উঠলে বোঝা যেত এইবার এ মালটি পার্টিকমরেড হয়ে উঠবে। হতও তাই। মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত লোকজন পার্টিঅফিসগুলিতে ভিড় করে, দু'চার বিঘে জমি বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা দিলেই ছেলে-মেয়েদের চাকরি পাক্কা। পাড়ার অশিক্ষিত অসামাজিক ছেলেটি হঠাৎই ব্লকলেভেলের কন্ট্রাক্টর হয়ে বেশ দু'পয়সা করে ফেলল।বলিয়ে-কইয়ে স্মার্ট উচ্চবিত্ত লোকেরা (এদের বেশিরভাগই বড় ব্যবসাদার) পার্টির জোনাল ও জেলাস্তরের নেতৃত্ব দখল করল।  

            আর যাঁরা পোস্টার-মারার জন্য ফোটানো অ্যারারুট খেয়ে, রক্ত দিয়ে সম্পদ দিয়ে জীবনীশক্তি দিয়ে বামপন্থীদের ক্ষমতায় নিয়ে এল তারা ব্রাত্য হয়ে মাথা নিচু করে অপমানিতের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। সমাজের লোকজন পেছনে প্যাঁক্ দিতে লাগল,"শালা গান্ডু! হাতে ক্ষমতা থাকতেও নিজের ভালোটা বুঝল না। এখন বুঝ্ শালা, সততা মারিয়ে কী হয়!!"

          অশিক্ষিত যুবক-যুবতীদের এটাই সুযোগ হয়ে উঠল পার্টি করে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার। তাদের সামাজিকভাবে বকাঝকা করার বুড়ো-বুড়িদের নোয়ানো ভাঙা কোমরগলো আরো একটু ছোট করে দেওয়ার। শালা-শালিরা খুব ফুটানি মারাত। "দ্যাখ বুড়া, কেমন লাগে!"

        আর প্রকৃত-শিক্ষিত ছাত্র-যুবদের মনে এই গ্রামীণ সংস্কৃতির অধঃপতন, ও আদর্শায়িত সমাজব্যবস্থা   ভেঙে যাওয়ার হতাশা দানা বাঁধতে থাকে।                           
          আমি তখন গড়বেতা কলেজের ফার্স্টইয়ারের ছাত্র। চন্দ্রকোনারোডে টিউশন পড়াই আর গড়বেতায় পড়াশোনা করি। গড়বেতা কলেজেরই এক সহপাঠী ও প্রকৃত কবি আমাকে সুদীপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।পরে আমরা দু'জনে মিলে মেদিনীপুরের এপিডিআর কর্মী প্রফেসর  স্বরূপ দাশগুপ্তের সাথে "সংঘাত"  নামে একটি পত্রিকা বের করি। তার কয়েকটিমাত্র সংখ্যা বেরিয়েছিল। সুদীপ এই পত্রিকা বের করার বিষয়ে আমাদের উৎসাহী   করেছিল।

         এইসময় সুদীপ চোংদার চন্দ্রকোনা রোডে মেশিনারি পার্টসের ব্যবসা করত। এদিকে আশিস মন্ডল, অসিত সরকার ও সুদীপ মিলে কাষ্ঠগুড়া নলপা ধবনি এলাকায় (গড়বেতা ১নং ব্লক) "বিপ্লবী কৃষক সমিতি" নাম দিয়ে এলাকার মানুষকে সংগঠিত করে সিপিএমের অত্যাচার ও  সামাজিক-ফ্যাসিবাদী কাজকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললে, সরকার ও রুলিংপার্টি (যে দুটোকে সিপিএম কখনোই আলাদা করে গড়ে তোলেনি) তাদের  রোষানলে পড়ে।

           আশিস মন্ডল সহ প্রায় তিরিশ জন কর্মী সমর্থকের বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়। ভজন চক্রবর্তী নামে এক কমরেডকে তুলে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে পিটিয়ে মারে। তাকে মারার কারণ তার ছেলে নকশাল করে।  তার ছেলে-মেয়েরা বাড়িছাড়া হয়। ভজন চক্রবর্তীর বডি আজও পাওয়া যায়নি। তৎকালীন পুলিশ কোনরকম অ্যাকটিভিটি দেখায়নি।  এমনকি এপিডিআর এর প্রতিনিধি দল থানায় অভিযোগ জানাতে  গেলে  পুলিশ এরকম কোন ঘটনাই ঘটেনি বলে। আবার মিথ্যে অভিযোগ করার কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে বলেও ভয় দেখায়                                                             এপিডিআর একটা কেস ফাইল করে। থানা একটি নিখোঁজ ডায়রি নেয়। সেই কেস বা নিখোঁজ ডায়রির কী হল আজও জানা যায়নি।
         বলা যায়,পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলো সিপিএম-বিরোধী লড়াইয়ের এটাই ছিল প্রথম অসংগঠিত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত  লড়াই। এর ফলে ১৯৯৩ সালে তিরিশজন মানুষের তিরিশটি পরিবার  তিনটে গ্রাম থেকে  ঘরছাড়া হয়। অসিত সরকার এদেরকে সংগঠিত করে সন্ধিপুরে (তাঁর বাড়ি) নিয়ে গিয়ে, রাখেন। কিন্তু তাঁদের ভরনপোষণ চলবে কীভাবে?
         তখন সন্ধিপুর এলাকাটা ছিল মরুভূমির মতো। চারিদিকে ঊষর প্রান্তর আর পাথুরে মাটি। এখানে চাষযোগ্য জমি খুবই কম, ফলে ভুমিহীন মানুষেরা তখন ওখানকার পাথর খাদানে পাথর তোলার কাজ করত। গড়বেতা থেকে সন্ধিপুর যাওয়ার যে রাস্তা ছিল তাতে ট্র্যাক্টর আর সাইকেল ছাড়া কোন যানবাহন চলার উপযোগী ছিল না। তখন গ্রামাঞ্চলে এত ট্র্যাক্টরও ছিল না। গরুর গাড়িতেই কাজ চলত বেশি। ভাবুন আজকের সিপিএমপন্থী কমরেডগণ, সতের বছর (সেই সময়) একটা নির্বাচিত কম্যুনিস্ট সরকারের আমলে গ্রামের মানুষ তখনো ট্র্যাক্টর ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। 

           অসিতদা'রা যে পাথর তুলতেন তা বাইরে যেত ব্যাডফোর্ড নামের একধরনের লঝ্‌ঝড় ট্রাকে করে।

           ঐ সময়ের গ্রামবাংলার মানুষ অনেক কিছুর থেকেই বঞ্চিত ছিল। সন্ধিপুর-চমকাইতলা এরিয়াটা ছিল মেদিনীপুর-হুগলি বর্ডারে। খেতমজুরএর কাজ করতে গেলেও আরামবাগ খানাকুল তারকেশ্বরে যেতে হত তাদের। মানুষের রোজগার না থাকার ফলে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইএর স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল চমকাইতলা-সন্ধিপুর। এই ডাকাত-ছিনতাইবাজ গ্যাংগুলোই ছিল তখন সিপিএমের বাহুবলী। সমস্তরকম ভোটের তারক ছিল এরাই। অসিতদা'রা প্রথম সফল হয় এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।  ঐ সময় আমি দেখেছি দিনে-দুপুরে ডাকাতি হতে। বিরুদ্ধমতের মানুষদের বাড়িতে বোম পড়তে। ভয় দেখানো হত তাদের। সম্পন্ন কৃষকবাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়তে  যেত ত্রিশ কিমি দূরের গড়বেতা কলেজে বা কামারপুকুর কলেজে। ফলে ভয়েই থাকতে হত তাদের। যানবাহন কম, রাস্তায় নানারকম বিপদ। 

           এই ঘরছাড়াদের নিয়ে এভাবে বেশিদিন তো চালানো   যাবে না। কলকাতার বিপ্লবী দলগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা হলেও, আমাদের মতের সাথে মিলছিল না,তাদের কাজ করার ধরণ-ধারণ। আসলে শহরকেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন বা শ্রমিকআন্দোলন এর সাথে গ্রামভিত্তিক কৃষকআন্দোলনের চরিত্রগত ফারাক আছে। শহরে বাকস্বাধীনতা আছে (সবকালেই গ্রামের তুলনায় কিছুটা বেশি থাকে), আন্দোলন করার, মিটিং-মিছিল বা জমায়েত করার স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু গ্রামের ক্ষেত্রে, অবস্থান ও চরিত্র, স্থানভেদে   আলাদা আলাদা  হয়। যেমন হুগলিজেলার কলকাতাসংলগ্ন মেট্রোপলিটন  এলাকা ও পশ্চিম হুগলির কৃষিপ্রধান এলাকার মধ্যে দুস্তর ফারাক।আবার মেদিনীপুর পূর্বের কৃষিপ্রধান এলাকার সাথে পশ্চিমের জঙ্গলমহল এলাকার দুস্তর ফারাক। এই দুই ধরনের এলাকার মানুষের রহন-সহন, ভাষার ডায়ালেক্ট, জীবনযাপন সবকিছুই আলাদা। রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের তাই এই এলাকাভিত্তিক মানুষদের বুঝতে জানতে অনেকটা সময় লাগে। মধ্যবিত্ত (নকশালি বইয়ের ভাষায় পেটিবুর্জোয়া), লেখাপড়া জানা  পরিবার থেকে মার্ক্স-লেনিন-রেডবুক পড়ে গ্রামে গেলাম ও আন্দোলন গড়ে বিপ্লব করে ফেললাম, -এই ধারণা নিয়ে আর যাই হোক মার্ক্সিজমের চর্চা বা প্রয়োগ কোনোটাই হয় না। 

          সেই সময় (১৯৯৪) অসিতবাবুর বাড়ি সন্ধিপুরে গড়বেতা এলাকা এবং বাইরের অ্যাকটিভিস্টদের নিয়ে একটা মিটিং হয়। তাতে সিদ্ধান্ত হয় আমরা কয়েকজন সরাসরি দন্ডকারণ্যে যাব এবং সিপিআই এমএল (পিপিলস ওয়ার) গ্রুপের সাথে  যে-কোন উপায়ে যোগাযোগ করব। কলকাতা থেকেও অ্যাকটিভিস্টরা আরভারা রাও এবং বিপ্লবী কবি গদর এর সাথে যোগাযোগ করে চলছিলেন। কিন্তু আমাদের সমস্যা হল হাতে টাকাপয়সা না থাকা। যে পাঁচজন যাবে তাদের থাকা খাওয়া রাহাখরচ কোত্থেকে জুটবে? 

           এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন গড়বেতার এক লরিচালক। তিনি আমাদেরকে অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ারেঙ্গল বা আদিলাবাদ জেলায় নামিয়ে দেবেন। তারপরের ভাবনা আমাদের।  (ক্রমশঃ)  
                   

No comments:

Post a Comment