বাক্‌ ১৪০ ।। এই সংখ্যার কবি ।। জহর সেন মজুমদার



কবি জহর সেন মজুমদার ১৯৬০ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি উত্তর চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত আড়বেলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। বাকিটা ইতিহাস। "বাক্" তার ১৪০তম সংখ্যায় তাঁর অপ্রকাশিত ১০টি নতুন কবিতাকে প্রকাশের মধ্যে দিয়ে 'এই সংখ্যার কবি' বিভাগে নিজেদেরই সম্মানিত করল 
                                                                                     -সোনালী চক্রবর্তী। বিভাগীয় সম্পাদক



“আসলে আমি এই নাগরিক যন্ত্রজীবনের অর্থহীন প্রতিযোগিতা এবং অর্থহীন কোলাহলের কেউ নই; একদিন গ্রাম থেকে এই যক্ষপুরীর গহ্বরে এসে ঢুকে পড়েছিলাম ---তারপর আর বেরোতেই পারলাম না --- প্রতিমুহূর্তেই ভেতরে ভেতরে তাই চাপ চাপ একটা অন্ধকার যন্ত্রণা অনুভব করি ---- কোথায় গেলো আমার সেই ইছামতী নদী ----- বাদুড়িয়া শ্মশান কিংবা ভাঙা ভাঙা জীর্ণ ধ্বংসস্তূপ ---- যার ভেতর একটা শব্দহীন নীরবতা ছিল আর নীরবতার ভেতর কলকা ও কল্কে আঁকতে আঁকতে আমি শুধু কথা বলেছিলাম আমার সঙ্গেই কিংবা ফুটো দেয়ালের ঝুলে থাকা টিকটিকি মাকড়সার সঙ্গে ----- কোথায় গেলো তারা সব কোথায় গেল? এই শহরের কোথাও তো এই নীরব আত্মচারিতার সুযোগ ও সম্মোহন নেই; এখানে তাই আছি ---- শুধু কোনোরকমে গ্রাসাচ্ছাদনে আছি ---- যখনই একটু চিরিক মারে মাথা ---- নিউরনের ধাক্কা তৈরি হয় ---- তৎক্ষণাৎ পালাই, ছুটে যাই, আস্তে গিয়ে বসে পড়ি গাছনদীর জীবনে...” (জহর সেন মজুমদার) 



গ্রন্থপঞ্জী :

| "জনৈক ঈশ্বরের বাণী" (১৯৭৯)
| "মহাকাল সমারূঢ়" (১৯৮৯)
| "শ্রাবণশ্রমিক" (১৯৮২, ১৯৮৭)
| "প্রসবসিঁদুর" (১৯৮৯)
| "হৃদয়প্রণীত সন্ধ্যাজল" (১৯৯৪)
| "ষড়রিপু ষড়যন্ত্র" (১৯৯৬)
| "বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিকরুম"  (১৯৯৮)
| "দূরগামী দেহযন্ত্রবীণা" (১৯৯৯)
| "মাধবী ও পরমেশ্বরী" (২০০২)
১০|   "বিপজ্জনক ব্রহ্মবালিকাবিদ্যালয়"  (২০০৪)

১১| "শাশ্বত বীজক্ষেত" (২০০৫)
১২| "মাতৃভক্ত হেলেসাপ" (২০০৮)

১৩| "তৃষিত ময়ূরের আত্মনিবেদন" (২০১০)

১৪| "অগ্নিসমগ্র" (২০১১)
       "সূর্যাস্ত সমগ্র" (২০১১)
       "প্রসব সমগ্র" (২০১১)
       "অরূপ সমগ্র" (২০১১)
আলাদা আলাদা কাব্যগ্রন্থ হিসাবে প্রকাশিত হলেও এই চারটি খণ্ড একটি কেন্দ্রীয় ভাবনার ধারাবাহিক প্রবাহসম্পৃক্ত কাব্যচর্চা, আদ্যোপান্ত একটাই সামগ্রিক কাব্যগ্রন্থ।

১৫| "ছয়টি হিজলগাছ" (২০১২)
১৬| "ভবচক্র"; ভাঙা সন্ধ্যাকালে"  (২০১৫)

১৭| "তমোনিদ্রা; ছাইমাখা ভোর" (২০১৭) 
১৮| "হাড়িকাঠ আর হাতকাটা কবি" (২০১৭)
১৯| "স্বপ্নগাছ; বোকা স্বপ্নগাছ"  (২০১৮)
২০| "কাঠবিড়ালির কবিতা" (২০১৮)
২১| "পিঁপড়ে আর পাঁজরের কবিতা" (২০১৮)
২২| "পবন পঞ্জী পানি" (২০১৯)

"আমার কবিতা" (২০১২) ও "শ্রেষ্ঠ কবিতা" (২০১৭) ২০১৫ অবধি রচিত কবিতার আনুপূর্বিক কাব্যসংকলন।


জহর সেনমজুমদারের একগুচ্ছ অপ্রকাশিত কবিতা



তুমি ভারি অদ্ভুত, কবিতার লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চেয়েছিলে বোধিবৃক্ষে পৌঁছে যেতে; তুমি ভারি অদ্ভুত, অখ্যাত রেলস্টেশনের পাশে একা বসে বসে চেয়েছিলে অদৃশ্য একটা ময়ূরপঙ্ক্ষী স্থাপন করতে; কিন্তু সেইমতো কিছুই হলো না- হৃদয় কাচবার মতো, কেচে পরিষ্কার করবার মতো, একটা সাবানও আজ পর্যন্ত কোথাও পেলে না তুমি; আসলে যেসব মানুষ মাটির জীবনে বাস করে সৌর জগতের সেলুনে চুল কাটতে যায়- তুমি কোনোদিনও তেমনটা ছিলেনা কখনও; আজকের যুগে কে নেবে তোমার স্বপ্নফণা? কেউ না কেউ না; তবুও গলা অবধি পাঁকে ডুববার পর তোমার মাথার উপর আজও ক্ষুধাতুর পাখি এসে বসে; কী করবে তুমি? তোমার হাতদুটো মাটির নীচে গাছের শিকড় দিয়ে বাঁধা; এই রাত্রে ক্ষুধাতুর ওই পাখিকে কী করে খাওয়াবে তুমি? স্বপ্নফণা আস্তে আস্তে ঢেকে যায় অন্ধকার মিথ্যে প্রজননে 





সারারাত গাছপালার নরম নাড়ি টিপে টিপে কী দেখছো তুমি? কবে গাছে ফল হবে, কবে গাছে ফুল হবে, কবে গাছে মৌমাছিরা এসে মউচাক বানাবে এসব একমাত্র বোকার মতো তুমিই জানতে চাও, কী হবে এসব জেনে, চারদিকে লালা পড়ছে, চারদিকে সবাই লাল জিভ বের করে জীবন চেটে নিচ্ছে, ঘুরন্ত নাগরদোলা ঘুরছে ঘুরছে, বজ্র পড়ছে, বীর্য পড়ছে, কাক কুকুর কেন্নো কুমির, আ আ প্রেম মাংস শীৎকার শীৎকার, নদীর পাশে আমরা চালা বেঁধেছি, গল্প করবো আড্ডা করবো আদিম আদিম, তুমিও এসো, আসবার সময় এক কল্কে লালা এক কল্কে বজ্র আর এক কল্কে বীর্য আনতে ভুলোনা কিন্তু, কাল যে প্রজাপতি আত্মহত্যা করেছিল- তাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাববার দরকার নেই, গাছপালা বনজঙ্গল থাকলে দেখবে প্রজাপতি আবার আসবে 





অজস্র লাল দাগ ভেড়ার মধ্যে একটা কালো দাগের ভেড়া হয়েই সারাজীবন রইলে তুমি 





চিড়িয়াখানার ভেতর সব ভাষা শেষ হয়ে যাবার পর তুমিও নীল রঙের আকাশ খুঁজেছিলে, লাল কাঁকড়ার যৌন উত্থান চেয়েছিলে, চাঁদ ঢাকা প্রেম, কয়েক মুহূর্ত যেন কাস্তে ও কামড়- আমরাও জানি রক্তমাংসের জীবন মাঝে মধ্যে এইরকম করে, তুমিও জন্ম জন্ম তাহারই শিকার, প্রত্যেকটা প্রলাপের ভেতর প্রত্যেকটা শীৎকারের ভেতর ঋত ও নৈঋতও বারবার পাল্টে যায়, তুমিও আস্তে আস্তে অতৃপ্ত, অচরিতার্থ, বুঝতে পারো, এই পৃথিবীর ভেতর একটি কালো ভেড়া আর কুয়ো ছাড়া কোথাও কিছু নেই, শুধু জিভের নীচে যতবার লাল টকটকে উনোন জ্বলবে, ততোবার ততোবার, লাশের উপর লাশ এসে পড়বে, একটার পর একটা লাশ, সঙ্গম শেষ হবে না





এই ভৌগোলিকে ভ্রষ্ট ও ভবঘুরে কালো হাঁস তুমি; জ্বলন্ত কড়াইয়ে বারবার তোমার জন্য চুমু ভাজা হয়; নুন নেই, গামছা নেই, রক্তগোধূলির এই মধুভাণ্ড যদি ঘূর্ণি তোলে তোমার ভেতর, আর ভয়, যৌন এক ভয় কায়া তরুবরে পোড়া তেল সংগ্রহ করে, আর তুমি অনিশ্চয়, অনিশ্চিত, চেপে ধরো মাথাভর্তি পুঁজ ও পোকা; কুকুর ও বিড়ালের পাশে পড়ে থাকে কাঁচা মৌরিফুল; কেউ নেই, কিছু নেই, শুধুমাত্র দু একটি নিভৃত বোকা গুহালিপি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ক্রমাগত ছুটে যায় দিগন্ত অবধি তারপর? সর্বনাশা বিষতন্ত্র- কেঁপে ওঠে নষ্ট ভূমি; তোমাকে দেখলেই মনে হয় আজও তুমি ভাঙা ইসকুল





এই শেষ সন্ধ্যা, এই শেষ রাত্রি, তুমিও শরীরের ভেতর থেকে সবরকম মউচাক ফেলে দিয়ে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছো, এই সৌরজগতের অজস্র অপ্রেম, পাপড়ি খুলবার ঘোরতর ষড়যন্ত্র পাপড়ি ছিঁড়বার ঘোরতর ষড়যন্ত্র, আর তবে সহ্য করতে পারলেনা তুমি, জল থইথই হেঁয়ালির ভেতর তোমার হাত থেকে একটার পর একটা লেখা খসে পড়ছে, যে অন্ধকার গর্ভ থেকে ভ্রূণ এসে চাঁদকে মুকুট করে মাথায় তুলেছিলো- কী আশ্চর্য তুমিও ভ্রূণ হয়ে চলে যাচ্ছো চলে যাচ্ছো সেই অন্ধকার নাড়িগৃহে সেই অন্ধকার কালগহ্বরে, একটার পর একটা একটার পর একটা লেখা, তোমারই লেখা, তোমারই পিছু পিছু জলে পড়ছে, ছমছমে জলে পড়ছে, তুমিও ভ্রূণ, শুধুমাত্র চাঁদে চলেছো, আস্তে আস্তে চাঁদে চলেছো 





শোনো তুমি কিচ্ছু বোঝোনা শোনো তুমি কিচ্ছু জানো না, শীতশিহরিত বার বার শীতশিহরিত, শীতশিহরিত ভয়ঙ্কর শীতশিহরিত, লিখে লিখে একদিন যোনিদ্বার যেই খুলে দিলে, রক্তমাখা দুটো প্রজাপতি ভেতর থেকে ক্রমাগত গড়িয়ে গড়িয়ে তোমার দিকেই যেন চলে এলো, চেয়ে রইলো তোমার দিকেই, হয়তো বা শাশ্বত যোনির ভেতর এতোদিন ঘুমিয়ে ছিলো, হয়তো বা শাশ্বত যোনির ভেতর এতোদিন চাঁদ ও মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করছিলো; তাই বলে তুমি ভয় পাবে কেন? তাই বলে তুমি এমন চমকে উঠবে কেন? জল হাওয়া অগ্নির ভেতর আজ পর্যন্ত যতো লেখা তুমি লিখেছো, সেই সব ব্যথাতুর লেখা সেই সব মেঘাতুর লেখা, ভয়ংকর শীতশিহরিত, যোনি থেকে নাভি, নাভি থেকে হৃদি- আরও আরও ওপরে উঠে যাচ্ছে, আরও আরও ওপরে 




বজ্রপাত শেষ হয়ে গেছে, বীর্যপাত শেষ হয়ে গেছে, অগ্নিপাত গর্ভপাত শেষ সব শেষ, তবুও বালুরাশির ভেতর জলের মতো, আঁকাবাঁকা আঁকাবাঁকা, তুমি জল শুধু জল, সান্ধ্যভাষার মতো, ভেসে চলেছো, ভেসে ভেসে, তোমার পিছু পিছু তিস্তার পোস্টমাস্টার, তোমার পিছু পিছু আত্রেয়ীর পোস্টমাস্টার, তোমার পিছু পিছু তুঙ্গভদ্রার পোস্টমাস্টার রান্না করা মাংসের ভেতর থেকে অল্প কিছু পাখি ও জোনাকি তুলে নিয়ে তোমার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে চলেছে, অন্ধকারে আজও ভেসে চলেছে 





তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় মাকড়সার জাল ছিঁড়ে তুমি আজও বেরোতে পারোনি; একটার পর একটা লাশ ইতিমধ্যে জলে ডুবে গেছে, শূন্যে শূন্যে ঝুলে আছে হাড় মাংস করোটির আশ্চর্য ছেঁড়া ক্যালেন্ডার, কোথাও একটাও হাতপাখা নেই- শুধু বঁড়শিবেঁধা চাঁদ বিপন্ন মাছের মতো ঘাই মেরে মেরে একসময় রক্তবমি করতে শুরু করে; নুন আর লবঙ্গ- নুন আর লবঙ্গ- জিভের ওপর স্বপ্নগুলো গলে গলে পড়ে; মাতৃতান্ত্রিক জানলায় দাঁড়িয়ে তুমিও বুঝে গেছো এক চামচ দুঃখ দু চামচ দুঃখ নিয়েই বারবারই চারপাশে তৈরি হয় গাঢ় অন্ধকার 



১০

আসলে সেই কবে ফুসমন্তরের ডাক শুনে তোমার নিভৃত ফুসফুস তোমাকে ছেড়ে নতুন ময়ূরপঙ্ক্ষী খুঁজে নিয়েছে; স্তরীভূত নরকে এক ঋতু যায়, স্তরীভূত নরকে দুই ঋতু যায়, তুমি কাঁদো না, তবুও বন্দর ভিজে গেছে; তুমি কাঁদো না - তবুও হেমবর্ণ রাস্তা ভিজে গেছে; আকস্মিক উল্কাপাতে বজ্রযোগীরও ধ্যান ভেঙে যায়; তুমি এখন তাহলে কী করবে? নতুন করে ধ্যানে বসবে? সন্ন্যাসিনীর যোনি চাইবে? হেমন্তের জাহাজ এসে তোমার সব প্রেম সব চুমু বন্দরের দোকান থেকে তুলে নিয়ে গেছে; আজ, কাল, মহাবোধি- তুমি আর কখনো কোনোদিনও নতুন চক্ষু সংকেতের লেখা কিছুতেই লিখতে পারবে না


No comments:

Post a Comment