বাক্‌ ১৪০ ।। অনুপম বলছি




এই বসন্তের বুকের মধ্যে শীত আছে। কিন্তু তার শক্তি এত নয় যে সে আমাদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারে। যা জাগ্রত, তার বুকের মধ্যে ঘুম আছে, তাই তার জাগরণ শাশ্বত হয়ে ধরা দ্যায়।
বাক্‌’-এর কথায় আসি। ভারতীয় ও বাংলাদেশীয় বাংলা সাহিত্যের এক মেলবন্ধন আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু দুই বাংলাতেই এই একই সংলাপ বলে অনেকে দুই বাংলার মধ্যে দূষণ ঘটাচ্ছেন। সীমান্তের অন্যপারে নিজের প্রতিপত্তি বিস্তার করার জন্য অন্যদের পথ আটকে রাখতে চাইছেন বিবিধ ফিকিরে। এতে সার্বিক বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি হচ্ছে।
প্রায় এক যুগ আগে, ২০০৯ খৃস্টাব্দে বাক্‌’-এর পথচলা শুরু হয়েছিল। আজও সে হেঁটে চলেছে। খরগোশ বা কচ্ছপ, কোনোকিছু হয়েই তার কোনো ছুট নেই, তাই তার কথামালায় ছুটিও নেইহ্যাঁ, তার কোনো দৌড় নেই, তাই প্রতিযোগিতাও নেই। যাঁরা বাক্‌’-কে রাইভ্যাল বা প্রতিস্পর্ধী জ্ঞান করেন, তাঁদের জেনেটিক কোডে আমরা অনেক আগেই জায়গা করে নিয়েছি। তাঁদের প্রতি স্নেহ রইল।
হে লেখক, বাণিজ্যিক পত্রিকাই কেবল ফাঁদ পাতে না, তথাকথিত লিটিল ম্যাগাজিনের জগতেও আছে অনেক টোপ, অনেক বাঁধন। সব কাটাতে হবে। ব্যক্তিগত হয়ে উঠতে হবে।
লিখুন। আত্মপ্রচার করুন। নিজের প্রচার আর বহনের ভার অন্যকে দেওয়ার আগে শতবার ভাবুন সে আপনাকে কিনে নিচ্ছে কিনা।
বাক্‌’-এর কোনো ঘোষিত সীমারেখা নেই। একটি শান্ত প্রাণীর মতো এগিয়ে গিয়ে গিয়ে সে একটি শীর্ণ নদীর জলে মুখ ডোবাতে চায়, আর নিজের ছায়ার দিকে তাকাতে চায়। সেই ছায়ায় ফেলে আসা সমস্ত পথটির পিপাসা লেগে আছে। সে একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান আজ। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মেকি পতাকায় বাক্‌’-এর কোনো লোভ নেই।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে বিস্তর ধূর্ততা বাংলা সাহিত্যে প্রদর্শিত হয়েছে। আজও হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানসর্বস্বতার মতোই ওটাও একজন লেখককে তার ব্যক্তিগত সাহিত্যচর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটা কৌশল। মগজ ধোলাই। অর্থাৎ তার একলা চলা হবে না, তাকে আরো অজস্র ব্যর্থ হতাশ লেখা ছেড়ে যাওয়া লেখকের সঙ্গে বৈপ্লবিক জোট বাঁধতে হবে। এর ফলে অনেক প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন লেখকের ক্ষতি হয়েছে, এই জোট বাঁধার ফলে ক্রমশ তাঁরা নিজস্বতা হারিয়েছেন।
আজও দেখি কিছু উজ্জ্বল তরুণ লিখতে এসেই ভাবে তাদের সুবিমলমিশ্র বা নবারুণ ভট্টাচার্যের মতো কিছু হতে হবে। এর ফলে যারা লিখতে এসেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হতে চায়, তাদের চেয়ে তারা কিছুমাত্র অধিক সুবিধা পায় না। শুরুতেই একটা খোপে আটকে যায়- জনপ্রিয় সাহিত্য না হোক জনবিরল সাহিত্যের খোপ সেটা। সেটাও সিস্টেমের গ্রাস যেটার মধ্যে একজন তরুণ সাহিত্যিক হজম হতে থাকে।
সাহিত্যের গতানুগতিক সিস্টেমের মধ্যে থেকে আপনি বাংলা সাহিত্যে কিছু করতে পারবেন না। সিস্টেমের বাইরে বেরিয়ে যান। কিছুদিন রেহাই পাবেন। তারপর অবিশ্যি সিস্টেম আবার আপনাকে গ্রাস করতে আসবে, যেমন শহর এগিয়ে আসে গ্রামকে গিলে নিতে, তখন গ্রাম শহরতলি হয়ে যায়। তাই অবিশ্রান্ত চলুন। যখন পারবেন না, লেখা থামিয়ে দিন। নাহলে লেখাই আপনাকে থামিয়ে দেবে। নিজেকে ক্রমাগত বদলাতে থাকুন।
আপনার বিবর্তনই আপনার লেখার বিবর্তন।
নিন্দিত হতে থাকুন। সবাই যে সবাইকে সাবধান করে দ্যায় যে, আপনার সঙ্গে মিশলেই সর্বনাশ। আপনাকে ঘিরে একটা নিঃশব্দের গণ্ডী কাটা হোক যেটা পেরোলেই আপনি ঘাড় ভেঙে রক্ত খেয়ে নেবেন, এই আতঙ্ক ধ্রুপদী হয়ে উঠুক।
এর মধ্যে রাষ্ট্র আর দেশের মধ্যে যা ঘটছে, যা ঘটে চলেছে, আগামীকাল যা যা ঘটতে পারে, সেখানে দাঁড়িয়ে বেশি কিছু বলার অবকাশ এখানে নেই। শব্দ হল ব্রহ্ম। শব্দ কখনও অশ্লীল হয় না। তার প্রয়োগ অশ্লীল হয়। যথাস্থানে যথাসময়ে সকল শব্দই শ্লীল ও পবিত্র। স্ল্যাং বা খিস্তি বা গালাগাল একটা ভাষার যুদ্ধ করার শক্তিকে প্রকাশ করে। ভাষার মধ্যে খিস্তির আকারে যে প্রকাশ বিদ্যমান থাকে, তা মানুষের যৌনশক্তির মতোআপনার সেক্স হরমোন যদি ঠিকঠাক থাকে, আপনার স্বাস্থ্য ঠিক আছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আপনি যত্রতত্র যার তার সঙ্গে শুয়ে বেড়াবেন। স্ল্যাং-ও যৌনক্রিয়ার মতোই বিষয়। এই মুহূর্তে স্ল্যাং বা খিস্তির প্রয়োগ ততটা শক্তিশালী ও সৃষ্টিশীলভাবে হচ্ছে না যতটা বাহারিভাবে হচ্ছে
তরুণ প্রজন্ম কিছু বাংলা স্ল্যাংকে আজকাল ফ্যাশন হিসাবে প্রয়োগ করছে, যেন বালবা বাঁড়াবলতে না পারলে তারা আপ টু ডেট থাকতে পারবে নাএতে ভাষার দূষণ অনিবার্য, কারণ যথাস্থান আর যথাসময়টা থাকছে না। দিনে চল্লিশবার কেউ যদি বাঁড়াবলে, আন্তর্জালেই সাতবার লেখে, তাহলে সেটা দিনে দশবার হস্তমৈথুনের বা পানিমেহনের মতোই তার ভাষার বাকি শক্তির বারোটা বাজাবে, ওই শব্দটা সেক্ষেত্রে যখন সত্যিই প্রয়োগের দরকার হবে, ওটার আলাদা কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, সত্যিকারের ঝগড়ার জায়গাটা তখন হস্তমৈথুনের বেকুব জায়গা হয়ে যাবে। এর ফলে কী হবে? ভাষা ফুরোবে, আর শারীরিক হিংসা বাড়বে। খিস্তিতে কাজ না হলেই মানুষ প্রহার করার দিকে যায়। একজন যদি তার বন্ধুকে দিনের মধ্যে সাত-আটবার এমনিতেই মাদারচোদ বলে, যখন সে সত্যিই ক্রুদ্ধ হবে কোনো বিশ্বাসঘাতকতার মুহূর্তে, তখনও ওই শব্দটাই বলবে, কিন্তু কাজ হবে না। তখন সে কী করবে? হয়ত একটা ছুরির বাঁট তার হাতে মধ্যে জেগে উঠবে তখন, কারণ ভাষা দিয়ে সে তখন আর পেরে উঠবে না।
একটা সমাজে তরুণরাই আসল। বুড়োদের নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হয় না। ভুল বুড়োরা করে না, কারণ তারা ভুল করার রিস্ক নেয় না। ভুল তরুণরা করে, কারণ তাদের সেই শক্তি সময় আর সাহস থাকে। তাই, সমালোচনা যদি কারও করতে হয় তরুণদেরই করা শ্রেয়আজকাল আমাদের সমাজে যারা দ্রুত বিখ্যাত হয়ে উঠছে, তারা তরুণদের ঘাঁটায় না, বরং আরো বিপথগামী হতেই উসকে দ্যায়, এতে তারা দ্রুত তরুণদের নয়নের মণি হয়ে ওঠে। আজকাল আইকন হওয়ার আর দ্রুত পপুলারিটির এটাই মূল চাবিকাঠি- তরুণদের মনের কথা বলে তাদের ফুসলে নাও। প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে দুটো খিস্তি দিলে, আর রবীন্দ্রনাথকে হ্যাটা করে ফেলতে পারলেই দারুণ প্রগতিশীল মনে হয় আজকাল
একটু CAA বিরোধিতা করে পোস্ট দিতে হবে, আর তারপরেই বান্ধবীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার ছবিধর্ষণের খবর পেলেই একটা আগুনমার্কা পোস্ট দিতে হবে, আর তার তিন ঘন্টা পরেই একটা রেস্তোঁরার ছবিগাঁজা বা মদ খাওয়াকে ক্যাজুয়ালি প্রমোট করতে হবে। প্রগতিশীলতার এরকমই খুব সস্তা একটা ফর্মুলা এখন বাজারে চলছে। বেদনার কথা হল, বামপন্থায় দীক্ষিত পরিবারের স্বচ্ছল ছেলেমেয়েরা এই ফর্মুলাটা আজকাল বেশি আঁকড়ে ধরছে, সম্ভবত সমাজের প্রতি একটা রুদ্ধ উদভ্রান্ত হতাশ পারিবারিক আক্রোশ তাদের মন থেকে এভাবেই নির্গত হচ্ছে। তারা নিজেদের অজান্তেই নাশকতার দূতদের এই সমাজের সংহারক হিসাবে চাইছে যে সমাজ তাদের লাল পতাকা বহনকারী পরিবারকে রাজনৈতিকভাবে অবান্তর করে দিয়েছে, কিন্তু বিত্তশালী রেখেছে
সার্বিকভাবে মনে হয়, শিক্ষাব্যবস্থার দীনতার কারণে তরুণদের একটা বিপুল অংশ এই সময়টাকেই চিরকালীন সময় ভাবছে। আজ থেকে ১০০ বছর আগেও বাঙালি কেমন ছিল, সে নিয়ে তাদের কোনো ধারণা বা মাথাব্যথা নেই। রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দ বা সুভাষ বোসের নামগুলো তাদের কাছে এখন কালিদাস বা হুসেন শাহ বা অদ্বৈত আচার্যের চেয়ে কিছু কাছের বা কাজের মনে হচ্ছে না। এমতাবস্থায় কী হতে পারে? একটা সমাজ থেকে সবার আগে সিরিয়াসনেস ও একাগ্রতা মুছে যাবে। এবং এতে লাভ হবে সেই সব নেতানেত্রীর, সেইসব উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিখ্যাত হতে চাওয়া লোকেদের যাদের মধ্যে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই, তারা নিজেরা মূর্খ, এবং জনসাধারণের ইতিহাস চেতনা তাদের কাছে সবচেয়ে অসুবিধার বিষয়। ফলে রবীন্দ্রগানের আগে খিস্তি ঢুকলে তাদের ঘোর আপত্তি হবে না, তারা একটু খেজুরে সংলাপ উচ্চারণ করেই দায় সারবে, এমন কি সমর্থনই জানাবে, এবং তরুণদের আরেকটু ঢালের দিকে গড়িয়ে দেবে, যাতে খাদের অন্ধকার ত্বরান্বিত হয়।
এবং গড়ানো যখন শুরু হয়েই গেছে, সেটা আর আটকানো যাবে কিনা, সেটা সময়ের দাবির হাতেই ছেড়ে দিতে হবে।
এই হল আবহমান, যা বলা এবং না বলার মাঝখান দিয়ে চলেছে।
আসুন, ‘বাক্‌ ১৪০’-এ প্রবেশ করা যাক।

                                                                      অনুপম মুখোপাধ্যায়
                                                                      পরিচালক- বাক্‌ অনলাইন




'বাক্‌ প্রকাশনী'-র এই দুটি বই সংগ্রহ করুন কলকাতার ধ্যানবিন্দু, মালদার পুনশ্চ, মেদিনীপুরের ভূর্জপত্র থেকে